২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে সরকার কর ও কর বহির্ভূত রাজস্ব থেকে ৪ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক অনুদান থেকে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। এর বিপরীতে, উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয়সহ মোট ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭,১৪,৪১৮ কোটি টাকা। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের ফলে বিগত অর্থবছরে ২,৩২,৯১৮ কোটি টাকার বাজেট ঘাটতি তৈরি হয়, যা বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে পূরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই বিপুল ব্যয়নির্ভর বাজেটে ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে রাজস্ব আহরণের উপর বরাবরই অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়। সরকার বিগত বছরগুলোতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জন্য প্রায়ই অবাস্তব রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে আসছে, এবং ফলস্বরূপ এনবিআর-এর রাজস্ব সংগ্রহ প্রতিবছর বাড়লেও নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না।
গত সমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে, নির্ধারিত ৪,৭৮,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের বিপরীতে এনবিআর ৪,০৮,৫৪৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে, যা সংশোধিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার ৮৫.৫ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব সংগ্রহ সংশোধিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার ৮৪.৫ শতাংশ ছিল। লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছানোর জন্য এনবিআর নতুন নতুন উপায়ে রাজস্ব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এনবিআর কর্তৃক করের আওতা বৃদ্ধির কিংবা ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলো দৃশ্যমান কার্যকর বা ইতিবাচক ফল বয়ে আনেনি। ফলে, নিয়মিত কর প্রদানকারী বৈধ ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধি করার চেষ্টা চলছে, তবে এটি দীর্ঘমেয়াদে কোনো কার্যকর সমাধান নয়।
বাংলাদেশের রাজস্ব আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস তামাক শিল্প। বিগত বছরগুলোতে, শুধু তামাক খাত মোট রাজস্বের ১১ শতাংশের বেশি অবদান রেখেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে, এই শিল্প থেকে প্রায় ৪০,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ১৬ শতাংশ বেশি। তামাকের উপর উচ্চহারে কর আরোপের পেছনে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও, ক্রমবর্ধমান রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যও এর অন্যতম উদ্দেশ্য। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ২৯,৭৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা মোট সংশোধিত বাজেটের মাত্র ৫.২ শতাংশ। ২০২১ সালে ৪৫টি স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল সর্বনিম্ন। এখান থেকে ধারণা করা যায়, তামাক শিল্প থেকে সংগৃহীত রাজস্ব স্বাস্থ্য খাতের পাশাপাশি অন্যান্য বিভিন্ন খাতে অর্থায়নের প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির চাপের কারণে মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে সরকার সিগারেটের সর্বনিম্ন মূল্য দুই দফায় বৃদ্ধি করেছে। এই আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে অবৈধ সিগারেটের ব্যবসা ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে, যা সরকারের রাজস্ব আয়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সিগারেটের স্তরভেদে সর্বনিম্ন মূল্য গত অর্থবছরের তুলনায় দুই ধাপে ২০ শতাংশ হতে ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। দ্রুত মূল্যবৃদ্ধির ফলে ক্রেতারা সস্তা বিকল্প খোঁজার প্রবণতা দেখাচ্ছে, যার ফলে অবৈধ সিগারেটের বাজার আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে। বিশেষ করে, নিম্ন আয়ের ভোক্তারা, যারা দামের প্রতি বেশি সংবেদনশীল, তারা অবৈধ সিগারেটের দিকে ঝুঁকছে।
সরকার প্রায়ই অবৈধ সিগারেট বাজার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও, বিদ্যমান অবকাঠামোর কারণে এই অবৈধ ব্যবসার বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ হলো, অবৈধ সিগারেট বাজার সম্পর্কিত কোনো নির্ভরযোগ্য সরকারি তথ্য-উপাত্ত নেই। সরকার ধারণা করতে পারে যে, মূল্যবৃদ্ধির ফলে সিগারেটের ব্যবহার কমছে, তবে বাস্তবে এই ব্যবহার অবৈধ বাজারে স্থানান্তরিত হচ্ছে। ফলে, একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে নিম্নমানের ও নামহীন ব্র্যান্ডের সিগারেট জনস্বাস্থ্যের জন্য নতুন হুমকি তৈরি করছে।
বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতার কারণে অবৈধ ব্যবসায়ীদের জন্য আরও অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করলেও পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। এমতাবস্থায়, সিগারেটের মূল্য আরও বৃদ্ধি করা হলে অবৈধ সিগারেট ব্যবসায়ীদের বাজারে প্রবেশ সহজ হয়ে যাবে। ফলে প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবৈধ সিগারেট উৎপাদন কারখানা গড়ে উঠতে পারে। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এসব অবৈধ সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিভিন্ন অপরাধী সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা বাড়তে পারে, যা দেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
বাংলাদেশ সরকার তামাক রাজস্বের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হওয়ায়, এই খাত থেকে ধারাবাহিক রাজস্ব বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতির জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি মাত্র খাতের উপর এত বেশি নির্ভরতা সিগারেটের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টিকে আরও সংবেদনশীল করে তুলেছে। যদি সরকার তামাক করের উপর নির্ভরতা কমানোর কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করে এবং একই সঙ্গে অবৈধ সিগারেট বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়, তবে দেশের অন্যতম প্রধান রাজস্ব উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা অর্থনীতির পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের জন্যও দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করবে। একইসঙ্গে, অবৈধ কার্যক্রম ও সন্ত্রাসী সংগঠনের বিস্তারও বাড়তে পারে, যা সামগ্রিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.