ডেনমার্ক থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পক্ষে থাকা গ্রিনল্যান্ডের মধ্য-ডানপন্থি ‘ডেমোক্রাতিট পার্টি’ সংসদ নির্বাচনে জয় পেয়েছে৷ এমন এক সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো, যখন ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন৷
যদিও ডেমোক্রাতিট পার্টি ট্রাম্পের দাবির বিরোধিতা করে বলেছে, গ্রিনল্যান্ডের ভবিষ্যৎ শুধু গ্রিনল্যান্ডবাসীদেরই নির্ধারণ করা উচিত৷ আর্কটিক অঞ্চলের এই দ্বীপে বিরল খনিজ সম্পদের বিশাল মজুদ রয়েছে, যা প্রযুক্তি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া এর অবস্থান উত্তর আটলান্টিকের কৌশলগত বিমান ও নৌপথে৷ সেখানে একটি মার্কিন বিমান ঘাঁটিও রয়েছে।
ডেমোক্রাতিট পার্টির নেতা জেন্স-ফ্রিডেরিক নিলসেন বলেছেন, ‘আমরা আমেরিকান হতে চাই না, আমরা ড্যানিশও হতে চাই না৷ আমরা গ্রিনল্যান্ডবাসী এবং আমাদের ভবিষ্যৎ স্বাধীনতা চাই। আমরা আমাদের দেশ নিজেদের শক্তিতেই গড়ে তুলতে চাই৷’
গ্রিনল্যান্ডের স্বাধীনতা সরাসরি ভোটের বিষয় না হলেও, এটি নির্বাচনি আলোচনার কেন্দ্রে ছিল৷ প্রায় ৩০০ বছর আগে ডেনমার্ক গ্রিনল্যান্ডকে উপনিবেশ বানায় এবং এখনো দ্বীপটির পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতির উপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে৷
দ্বীপটির ৫৬ হাজার বাসিন্দার বেশিরভাগই আদিবাসী ইনুইট জনগোষ্ঠীর৷ ২০০৯ সাল থেকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে চললেও, কবে ও কীভাবে এটি অর্জন করা উচিত তা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতভেদ রয়েছে৷ দ্বিতীয় স্থানে থাকা নালেরাক পার্টি স্বাধীনতার পক্ষে সবচেয়ে জোরালো অবস্থান নিয়েছে৷ তবে ডেমোক্রাতিট তুলনামূলক ধীর গতির পরিবর্তনের পক্ষে৷ গ্রিনল্যান্ডে মোট ভোটদাতার সংখ্যা ৪০ হাজার। পার্লামেন্টে আসন আছে ৩১টি। ডেমোক্রাতিট ৩০% ভোট পেয়ে বড় জয় পেয়েছে, যেখানে ২০২১ সালের নির্বাচনে তাদের ভোট ছিল মাত্র ৯%৷ নালেরাক পার্টি প্রায় ২৫% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে এসেছে, যা আগের ১২% থেকে দ্বিগুণ হয়েছে৷
ডেনমার্কের তত্ত্বাবধানে স্বায়ত্ত্বশাসন ভোগ করে গ্রিনল্যান্ড। সেখানে একটি স্বাধীন সরকার আছে। তবে পররাষ্ট্রনীতি, সামরিক নীতি এবং অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে ডেনমার্ক। দীর্ঘদিন ধরেই গ্রিনল্যান্ডের এক অংশের মানুষ পূর্ণ স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের দাবি করছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণার পর এই দাবি আরও জোারালো হয়েছে। নির্বাচনে তার প্রভাব পড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। অর্থাৎ, ডেনমার্কের থেকেও আলাদা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
ডেনমার্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ট্রোলস লুন্ড পউলসেন ডেমোক্রাতিট পার্টিকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, নতুন সরকারকে সম্ভবত ট্রাম্পের ব্যাপক চাপ মোকাবিলা করতে হবে। ডেনিশ রাজ্যের একটি অংশকে কেউ হুট করে নিয়ে যেতে পারবে না। গ্রিনল্যান্ডের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে গ্রিনল্যান্ডবাসী এবং তাদের সরকার।
ডেনিশ প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেন নির্বাচনের ফলকে গণতন্ত্রের বিজয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, সরকার কোয়ালিশন আলোচনার জন্য অপেক্ষা করবে।
ট্রাম্প জানিয়েছেন, কৌশলগতভাবে গ্রিনল্যান্ড একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। সে কারণে আমেরিকা গ্রিনল্যান্ড হস্তগত করতে চায়। গ্রিনল্যান্ডের রাজনীতিতেও ট্রাম্প প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছেন।
গ্রিনল্যান্ডের রাজনীতিবিদ পিপালুক লেঙ্গে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘এ বছরের গোড়া থেকেই আমরা অত্যন্ত চিন্তিত। কারণ, ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ড দখলের ডাক দিয়েছেন।’ বস্তুত, ২০০৯ সাল থেকে পূর্ণ সার্বভৌম রাষ্ট্রের দাবি জানাচ্ছে গ্রিনল্যান্ড। তারা ডেনমার্ক থেকেও আলাদা হয়ে যেতে চাইছে। ট্রাম্পের ঘোষণা সেই দাবিকে আরো ইন্ধন দিয়েছে।
জনমত সমীক্ষায় স্পষ্ট গ্রিনল্যান্ডের অধিকাংশ মানুষ আমেরিকার অংশ হতে চান না। অনেকেই পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে। গ্রিনল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ তেল, খনিজ, সোনা, ইউরেনিয়াম এবং জিঙ্ক সঞ্চিত আছে। আমেরিকা এই খনিজ নিজেদের দখলে নিতে চায়। সে কারণেই গ্রিনল্যান্ড অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে ট্রাম্প এতটা আগ্রহী।
পরিবেশের দিক থেকে গ্রিনল্যান্ড অত্যন্ত সংকটে। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে বরফ গলে যাচ্ছে। ভেঙে পড়ছে হিমবাহ। এই পরিস্থিতিতে খনিজ তোলা শুরু হলে পরিবেশের আরো ক্ষতি হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
গ্রিনল্যান্ডের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী মুটে বোরুপ এগেদে ফেব্রুয়ারিতে এই নির্বাচন ঘোষণা করেছিলেন৷ তার দল ইনুইট আতাকাটিগিত মাত্র ২১% ভোট পেয়েছে, যা আগের ৩৬% থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কম। নির্বাচনের পর, এগেদে জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন যে এখন দলগুলো সরকার গঠনের জন্য আলোচনায় বসবে।
এই ফলাফল ইঙ্গিত দিচ্ছে যে গ্রিনল্যান্ডের ভবিষ্যৎ স্বাধীনতার দিকেই যাচ্ছে, তবে কীভাবে এবং কত দ্রুত, তা নির্ধারণ করবে নতুন সরকার। সূত্র: ডিডাব্লিউ, রয়টার্স, এপি
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.