আজ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। বাঙালি জাতির দীর্ঘ স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বড় এক বাঁক বদলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে এমন এক দিনে। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা-সংগ্রামের ডাক দেন।
অবশ্য এই ঘোষণার আগে অন্তত: দুইবার মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের কাগমারী (সন্তোষ) সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশে তিনি বলেছিলে ‘আসসালামু আলাইকুম’। পরে ১৯৭০ সালের ২৩ নভেম্বর পল্টন ময়দানের জনসভায় পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশে ‘লা কুম দ্বীনি কুম ওয়াল ইয়া দ্বীন’ বলে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করেন। তবে এ দু’টি ঘোষণা ততটা স্পষ্ট ছিল না। ৭ মার্চের জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান সুস্পষ্টভাবে স্বাধীনতার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
ওই জনসভায় তিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, যার যা কিছু আছে, তা নিয়েই শক্রর মোকাবিলা করতে হবে। রাস্তাঘাট যা যা আছে…. আমি যদি তোমাদের হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা সব বন্ধ করে দিবে।’
লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ’।
তাঁর এ বক্তব্য পুরো বাঙালি জাতিকে উদ্দীপ্ত করে। তারা স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ হয়ে সম্ভাব্য লড়াইয়ের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
৭ই মার্চের এ ঘোষণার পটভূমিতে ছিল ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং জয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠির টালবাহানা। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী এই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা টালবাহানা করতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রবল জনদাবির মুখে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করলেও ১লা মার্চ তা অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করা হয়। এতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় স্বাধীনার জন্য লড়াইয়ের আহ্বান ও সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখ রাতে বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে পাকিস্তানী হায়েনাদের অতর্কিত হামলায় ভেঙ্গে পড়েনি বাঙালিরা। ২৫ মার্চ রাতেই শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় অনেকটা খালি হাতে তারা রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে।
২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন মেজর জিয়াউর রহমান। পরবর্তীতে শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ ও শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ও সর্বাধিনায়ক ছিলেন জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী। সেনা ও পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রসহ সব স্তরের মানুষ মুক্তিবাহিনীর হয়ে দেশের জন্য যুদ্ধে নামে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে তাই ৭ই মার্চের বক্তব্যের একটি বড় ভূমিকা রয়ে গেছে। এ বক্তব্য শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব পরিসরেও নানাভাবে আলোচনায় এসেছে। ২০১৭ সালের ৩০শে অক্টোবরে ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণকে “ডকুমেন্টারি হেরিটেজ” (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ৭ই মার্চকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করে এক মাসের মধ্যে গেজেট জারির নির্দেশ দেয়। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে দিনটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করে পরিপত্র জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। পরের বছর থেকে দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন করতে থাকে তৎকালীন সরকার ও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ।
দিনটিতে সরকারি ছুটি না থাকলেও জাতীয় পতাকা উত্তোলন, দেশজুড়ে ভাষণ প্রচার, স্কুল-কলেজে নানা সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, উপাসনালয়ে প্রার্থনা, শেখ মুজিবের বায়োপিকসহ বিভিন্ন প্রদর্শনী, মন্ত্রণালয়ের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, জেলা-উপজেলা প্রশাসন বা ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে নানা কর্মসূচি নেওয়া হতো। দিবসটি উদযাপনে বাড়াবাড়ি এবং বিপুল অর্থ অপচয়ের অভিযোগ উঠে।
গত বছরের ৫ আগস্ট প্রবল গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামীলীগ সরকারের পতন হলে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। ওই বছরের ১৭ অক্টোবর সরকার ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসসহ আটটি জাতীয় দিবস উদ্যাপন সিদ্ধান্ত নিয়ে এক আদেশ জারি করে।



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.