অর্থনীতি সমিতি জবরদখলের চেষ্টা!

পেশাজীবী অর্থনীতিবিদের সংগঠন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতিতে ফের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। পতিত আওয়ামীলীগের ঘনিষ্ট কিছু ব্যক্তি নিজেদেরকে বৈষম্যবিরোধী দাবি করে সম্প্রতি রাতের অন্ধকারে সমিতির অফিস দখল করেছে। এদের বিরুদ্ধে সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ভয়-ভীতি দেখানোরও অভিযোগ উঠেছে। গতকাল সোমবার দখলকারীদের পক্ষ থেকে একটি সংবাদ সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগ নিলে অন্তবর্তীকালীন কমিটির সদস্য ও সমর্থকরা তাতে বাধা দেয়। এতে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে ওই সংবাদ সম্মেলন স্থগিত হয়ে যায়।

অন্তবর্তীকালীন কমিটি এ বিষয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের পেশাজীবী অর্থনীতিবিদদের এ সংগঠনটি আওয়ামীলীগের সুবিধাভোগী কিছু অর্থনীতিবিদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে ছিল। বিরোধী দলের সমর্থক এবং দল নিরপেক্ষ প্রকৃত পেশাজীবী অর্থনীতিবিদরা ছিলেন কোনঠাসা। সংগঠনটিকে এর নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিবর্গ নিজেদের স্বার্থে এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক আওয়ামীলীগকে নানাভাবে সমর্থন জোগানোর কাজে ব্যবহার করেছে। গত বছর সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যেই সংকট দেখা দেয়। আওয়ামী সমর্থক অর্থনীতিবিদদেরই আরেকটি গ্রুপ সংগঠনের নিয়ন্ত্রণকারী গ্রুপটিকে চ্যালেঞ্জ করে নির্বাচনে অংশ নেয়। তবে নির্বাচনে তারা পরাজিত হয়।

গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের পতন হলে নির্বাচনে পরাজিত গ্রুপটি ফের সক্রিয় হয়। তারা নিজেদের ভোল পাল্টে নিজেদের বৈষম্যবিরোধী দাবি করে একটি অ্যাডহক কমিটি গঠন করে। শুরু হয় সমিতি দখলের পাঁয়তারা। আর একে কেন্দ্র করেই দেখা দেয় জটিলতা যা ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে।

জানা গেছে,  বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাংলাদেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদগণ এ সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস; শিক্ষা ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ; অর্থ ও বাণিজ্যবিষয়ক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ অতীতে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির নির্বাচিত সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষসহ কার্যনির্বাহক কমিটির বিভিন্ন পদে ছিলেন।
এরই ধারাবাহিকতায় গঠনতন্ত্র মোতাবেক গত বছরের ১৮ মে অর্থনীতি সমিতির ২২তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলন সাধারণ সভা ও কার্যনির্বাহক কমিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ও অধ্যাপক ড. মোঃ আইনুল ইসলাম-এর প্যানেল জয়লাভ করে। ড. মোঃ আজিজুর রহমান ও সৈয়দ মাহবুব-ই-জামিল এর নেতৃত্বাধীন প্যানেলটি পরাজিত হয়।

নির্বাচিত কার্যনির্বাহক কমিটি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সমিতির স্বাভাবিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছিল। কিন্তু ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর  নির্বাচনে পরাজিত প্যানেলের ড. মোঃ আজিজুর রহমান ও সৈয়দ মাহবুব-ই-জামিল এর নেতৃত্বে আরও কয়েকজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপে ‘বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি’ ব্যানারে ঐতিহ্যবাহী এই সমিতির কার্যক্রম বন্ধের হুমকি দিয়ে “নির্বাচিত কার্যনির্বাহক কমিটি” উৎখাতের হুমকি দেয়

গত ৩০ সেপ্টেম্বর তারা পাল্টা কার্যক্রমের ঘোষণা দিয়ে তথাকথিত একটি এডহক কমিটি গঠনের কথা জানায়। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি রমনা থানায় গত ২৩ আগস্ট একটি অবহিতকরণপত্র এবং পরে একটি সাধারণ ডায়েরি (নম্বর-১১৭৭, তারিখ-২৭-৮-২০২৪) করে।
গত ৩ অক্টোবর ওই এডহক কমিটির ১০-১২ জন সদস্য সমিতির ইস্কাটনস্থ ভবনের মূল গেইট ও ১ম তলা-২য় তলার কলাপসিবল গেটের তালা ভেঙ্গে সমিতি ভবন দখলে নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে নিজেদের তালা লাগিয়ে সমিতি অফিসের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। গত ৭ অক্টোবর এডহক কমিটির নামে কিছু লোক সমিতি অফিসের প্রশাসনিক কক্ষের তালা ভেঙ্গে কক্ষটি দখলে নেয়।

সমিতির অফিস তাদের দখলে থাকলেও সমিতির গঠনতন্ত্র ও দেশের আইন অনুযায়ী ব্যাংকসহ আর্থিক লেনদেনের আইনগত কোনো এখতিয়ার তাদের ছিল না। ফলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায়, দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ঐতিহ্যবাহী অর্থনীতি সমিতির কিছু সদস্য এগিয়ে এসে নির্বাচিত কার্যনির্বাহক কমিটির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে নতুন একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন। এমন এক প্রেক্ষাপটে গত ১৯ ও ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখ নির্বাচিত কার্যনির্বাহক কমিটির সভাপতি ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ এবং সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মোঃ আইনুল ইসলাম-এর নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের প্রতিনিধিদল সমিতির ভাবমূর্তি ও ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে সমিতির আজীবন সদস্য অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ্-এর নেত্বত্বে কয়েকজন সমিতির সদস্যের সঙ্গে বৈঠক করেন।  দ্বিপাক্ষিক এসব আলোচনাকালে অর্থনীতি সমিতির গঠনতন্ত্রের বিধানবলে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য সমাধান এবং সমিতির অন্তর্বর্তীকালীন কমিটিতে সাম্প্রতিক সময়ে অরাজকা-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, বেআইনি কার্যক্রম পরিচালনাকারী ও সমিতির ভাবমূর্তি বিনষ্টকারী অবৈধভাবে গঠিত তথাকথিত এডহক কমিটির কোনো সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত না করার বিষয়ে উভয়পক্ষ একমত হন।

নির্বাচিত কার্যনির্বাহক কমিটি বাংলাদেশের পরিবর্তিত বিশেষ রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি, সামগ্রিক প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির আদর্শ, ঐতিহ্য ও ভাবমূর্তি বিবেচনায় নিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২০২৪-২৬ মেয়াদকালের জন্য ‘নির্বাচিত কার্যনির্বাহক কমিটি’ সমিতির গঠনতন্ত্রের ধারা “ঙ কার্যনির্বাহক কমিটির কার্যবিধি (৫), (৭), (৮)” অনুসরণ করে অর্থনীতি সমিতির কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচিত কার্যনির্বাহক কমিটির অনুমোদনক্রমে গঠিত ২৯ সদস্যের একটি অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির কাছে হস্তান্তর করবেন। ২৯ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন কমিটিতে একজন কনভেনর বা আহ্বায়ক ও একজন সদস্য সচিব থাকবেন। নির্বাচিত কার্যনির্বাহক কমিটির অনুমোদনক্রমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির প্রধান দায়িত্ব হবে অনধিক এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাধারণ সভা ও কার্যনির্বাহক কমিটির নির্বাচন আয়োজন করা এবং সমিতির বার্ষিক দাপ্তরিক কার্যক্রমসমূহ পরিচালনা করা।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহকে আহ্বায়ক  এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিনকে সদস্য সচিব করে “অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি” গঠন করা হয়।

অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির অভিযোগ গত ১২ ফেব্রুয়ারি বিকালে ড. আজিজুর রহমান ও মাহবুব-ই-জামিল-এর নেতৃত্বে সমিতির ৮-১০ জন সদস্য অর্থনীতি সমিতির বৈষম্যবিরোধী সদস্যের ব্যানারে ৫০ থেকে ৬০ জন বহিরাগত এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সমন্বয়ক ও নাগরিক কমিটির প্রতিনিধির নাম নিয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির অফিসে অতর্কিতে প্রবেশ করেন। তারা অফিসে অবস্থানরত অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির সদস্য (দপ্তর) মোস্তফা সাইফুল আনোয়ার বুলবুল, আজীবন সদস্য মোঃ আমিনুর রহমান এবং সমিতির নিরাপত্তাকর্মীসহ সকল কর্মচারীদের মিটিং রুমে যেতে বাধ্য করেন। সদস্য দপ্তরসহ অফিস স্টাফদের মোবাইল তারা ছিনিয়ে নেন। একটি গ্রুপ সমিতির অফিসের সিসি ক্যামেরাসহ ইন্টারনেটের যন্ত্রাংশ এবং সমিতির প্রশাসনিক দপ্তরে রক্ষিত সমিতির কার্যক্রমের জন্য ব্যবহৃত প্যাটি ক্যাশের ১২ হাজার টাকা এবং সমিতি স্টাফের দুপুরের খাবারের বক্সসহ একটি ব্যাগ নিয়ে যায়। এমন বিশৃঙ্খল পরিবেশে বাইরের সঙ্গে সকল প্রকার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। বিশৃঙ্খলাকারীরা জোরপূর্বক সমিতির অফিস অবৈধভাবে দখল পাঁয়তারার অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির সদস্য দপ্তর জনাব মোস্তফা সাইফুল আনোয়ার বুলবুলকে দিয়ে জোরপূর্বক অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির কার্যক্রম স্থগিত বিষয়ে একটি পত্রে স্বাক্ষরে বাধ্য করেন, যা অর্থনীতি সমিতির মতো স্বনামধন্য পেশাজীবী সংগঠনের জন্যে অত্যন্ত নীতিগর্হিত অপেশাদার কাজের পর্যায়ে পরে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি তার দীর্ঘ ৫০ বছরের ইতিহাসে দেশের অনেক উত্থান-পতনের সাক্ষী হলেও এ ধরনের নজিরবিহীন ঘটনা প্রত্যক্ষ করেনি।
বর্তমান অন্তর্বর্তী কমিটির অভিযোগ দখলের নেতৃত্বে ছিলেন নটরডেম কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক রাজেন্দ্র কলেজের সাবেক ছাত্রলীগের নেতা ড. মো. আজিজুর রহমান, জনতার মঞ্চে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী সাবেক যুগ্ম সচিব সৈয়দ মাহবুব-ই-জামিল, আওয়ামী লীগের ভোট কারচুপির প্রত্যক্ষ সহযোগী সচিব গ্রুপের সদস্য ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বিতর্কিত সাবেক চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ, আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি এবং জনতার মঞ্চের নেতৃত্বদানকারী সাবেক সচিব ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের একান্ত সহযোগী পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমীর গবেষণা পরিচালক ড. নুরুজ্জামান এবং সিদ্ধেশ্বরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষক ও ছাত্রলীগ নেতা এবং বর্তমান যুবলীগ কর্মী মুসলেহ উদ্দিন রিফাত। সৈয়দ মাহবুব-ই- জামিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর একান্ত সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
বিষয়টি অন্তর্বর্তী কমিটি থানাকে অবহিত করলে পুলিশ এসে সমিতির কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়। পরবর্তীতে ওই তারা ভেঙ্গে আবারও ড. মো. আজিজুর রহমানের সমর্থকরা সমিতির কার্যালয় দখল করে।

যোগাযোগ করলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির অন্তর্বর্তী কমিটির সদস্য সচিব ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন অর্থসূচককে বলেন, তারা পেশাজীবী অর্থনীতিবিদদের এ সংগঠনটিকে একান্ত পেশাদার সংগঠন হিসেবে পরিচালনা করতে চান। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা একটি গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করতে চান যাতে সদস্যরা তাদের পছন্দের নেতৃত্ব নির্বাচন করতে পারেন।

তিনি বলেন, অর্থনীতি সমিতি খুবই মর্যাদাশীল একটি সংগঠন। তাই তারা কোনো ধরনের সংঘাতে জড়িয়ে এর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে চান না। এ কারণে তারা আইনী পথে এটির পরিচালনা নিশ্চিতের চেষ্টা করছেন।

যোগাযোগ করলে কথিত এডহক কমিটির আহ্বায়ক ড. আজিজুর রহমান নিজেদেরকে বৈধ বলে দাবী করেন। আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.