বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, এস আলমসহ বড় কয়েকজন ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে কে কত টাকা নিয়েছেন, তা তাঁরা নিজেরাও জানেন না। আমরাও এখনো পুরোটা জানতে পারিনি। তবে ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান যাচাই শুরু হয়েছে। পাশাপাশি ফরেনসিক নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এতে বেরিয়ে আসবে কে কত টাকা নিয়েছেন, সুবিধাভোগী কারা ছিল।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এ কথা বলেন। সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এস আলমসহ ১০টি শিল্প গ্রুপ ও শেখ পরিবার নিয়ে যৌথ তদন্ত হচ্ছে, তারা আসলে কত টাকা নিয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ‘প্রাথমিক হিসাবে এস আলম একা ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসা করলেও বলতে পারবে না, কত টাকা নিয়েছে। জাভেদ (সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী) বিদেশে সাড়ে ৩০০ বাড়ি কিনেছেন। এত বাড়ির ঠিকানা তিনি দিতে পারবেন না।’
সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো সম্পর্কে গভর্নর বলেন, তাদের তারল্য–সহায়তা দেওয়া হয়েছে, প্রয়োজনে আরও দেওয়া হবে। ইসলামী ব্যাংক ও ইউসিবি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাদের আর সহায়তার প্রয়োজন হবে না। আমানতকারীদের স্বার্থ দেখা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ, সেটা করা হচ্ছে। এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে সংস্কার করা হবে, এর ফল পেতে সময় লাগবে। সব প্রক্রিয়া শেষে পুরো ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী ভিত্তি দিতে তিন-চার বছর সময় লাগবে।
শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও বাংলাদেশ কেন পারছে না—এ প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়ে পড়েছিল। খাবার ও তেলের জন্য সেখানে লাইন পড়েছিল। বাংলাদেশ সেই পরিস্থিতিতে পড়েনি। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা চলে না। বাংলাদেশের চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাব ইতিবাচক। বিনিময় হার স্থিতিশীল, রিজার্ভও বাড়ছে।
অনিয়মে জড়িত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, ‘কী অনিয়ম হয়েছে, তা সবাই জানি। কে সহায়তা করেছে, তা খুঁজে সময় নষ্ট করতে চাই না। ব্যাংক খাতের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি জোরদার করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে খারাপ ঋণ আর বিতরণ না হয়। অনিয়মের ঋণ উদ্ধারে দেশি-বিদেশি সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। পাচার করা অর্থ উদ্ধারে কাজ চলছে।’
মুদ্রানীতির কারণে বিনিয়োগ কমে কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ‘আমি আগে থেকেই বলে আসছি, ২০২৪ ও ২০২৫ সাল প্রবৃদ্ধি অর্জনের বছর নয়। এই দুই বছর অর্থনীতি মেরামত করার বছর। রাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে এমনিতেও বিনিয়োগ হবে না। সবকিছু মুদ্রানীতি দিয়ে হবে না। আমাদের প্রধান লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে কেউ বাধা দিচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ‘কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বাধা দিচ্ছে না। তবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমার বিরুদ্ধেও তারা কাজ করছে।’
ডলারের দাম কবে বাজারভিত্তিক হবে, জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, ‘এখনো সে সুসময় আসেনি। এখনো ডলারের দাম বাড়ানোর জন্য কিছু মধ্যস্বত্বভোগী কাজ করে যাচ্ছে। তারা প্রবাসীদের ডলার কিনে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমরা ব্যাংকগুলোকে বলে দিয়েছি তাদের থেকে ডলার না কেনার জন্য। ডলারের দাম মধ্যস্বত্বভোগীরা ঠিক করতে পারে না, এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঠিক করবে।’
ব্যাংক পরিচালকদের বিষয়ে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘স্বতন্ত্র পরিচালকদের একটা তালিকা করা হবে। সেখান থেকে পরিচালক নিয়োগ করতে হবে। আমি মনে করি, অর্ধেক পরিচালক স্বতন্ত্র হওয়া উচিত। ২ শতাংশ শেয়ার দিয়ে পরিচালক হওয়া বন্ধ ও পরিচালকদের মেয়াদ কমিয়ে আনা দরকার। এ জন্য আমরা আইন পরিবর্তনের প্রস্তাব করব।’
নীতি সুদহার কমানোর বিষয়ে গভর্নর বলেন, ‘সুদহারের ওপর নির্ভর করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ কাজে আসছে। এখন সব দেশ নীতি সুদহার কমিয়ে আনছে। আমাদের সেই সময় এখনো আসেনি। সময় হলে সেই উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.