সরকারের কাছে ৭০০ কোটি টাকা ঋণ চায় বেক্সিমকো

দেশের আর্থিক খাতে ব্যাপক অনিয়মে জড়িত বেক্সিমকো গ্রুপের লে-অফ থাকা গার্মেন্টস ও এর সাথে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান সচল করতে সরকারকে ৭০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত ঋণের বিপরীতে কাঁচপুরে অবস্থিত গ্রুপটির ২৩ একর জমি বন্ধক (মর্টগেজড) রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরামের সম্মেলন কক্ষে বেক্সিমকো গ্রুপের শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট সকল ভুক্তভোগীর পক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে গ্রুপের হেড অব অ্যাডমিন আব্দুল কাইয়ুম এসব কথা বলেন।

আব্দুল কাইয়ুম বলেন, বেক্সিমকো গ্রুপের বন্ধ থাকা গার্মেন্টস ও অন্যান্য কারখানাগুলোতে কর্মরত প্রায় ৪২ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ও তাঁদের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় ১০ লাখ মানুষের আর্থিক দুরবস্থা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ কাটিয়ে উঠতে সকারকের বিভিন্ন মহালে আমরা ১৫ থেকে ২০টি প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু কোন দিক থেকে কোন প্রকার রেসপন্স পাচ্ছি না। সর্বশেষ কাঁচপুরে অবস্থিত বেক্সিমকো গ্রুপের ২৩ একর জমি বন্ধক রেখে ৭০০ কোটি টাকা ঋণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে সরকারকে। ঋণ থেকে লজেস্টিক, ওয়েজেস ও স্যালারিসহ প্রত্যাকটার খরচ বাবদ প্রতিমাসে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের প্রায় ১০০ কোটি টাকা দিতে হয়। সেটাকে খরচ হিসাবে ধরে ৭০০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি কাজ শুরু করতে পারলে ৪ মাস পর থেকে আমাদের যে আয় আসবে, সেখান থেকে প্রতিমাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমান টাকা বেক্সিমকোর আগের দায় দেনা বাবদ পরিশোধ করা সম্ভব। এভাবে বছরে প্রায় সাড়ে ৪৫০ কোটি টাকার মতো সরকারকে বেক্সিমকো রিটার্ন করতে পারবে।

তিনি বলেন, মালিক পক্ষ এ সমস্যা সমাধানের জন্য দুই পা সামনে বাড়ালেও সরকার অজানা কারণে এক পাও সামনে বাড়চ্ছে না। এতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে কর্মরত প্রায় ৪২ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ও তাঁদের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় ১০ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা। আমরা এখান থেকে উত্তরণের জন্য সকল অংশীজনের কাছ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ আশা করছি। সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে আমাদের কোন আপত্তি নেই, আমাদের শুধু চাওয়া প্রতিষ্ঠান চালু করা হোক।

এ সময় তিন দফা দাবিসহ লিখিত বক্তব্য তুলে ধরে বেক্সিমকোর এস আর ম্যানেজার ইনাম উল্লাহ আজিম বলেন,  গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে অদ্যাবধি বেক্সিমকো গ্রুপের গার্মেন্টস ও এর সাথে সম্পর্কিত কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এই গুলোতে কর্মরত প্রায় ৪২ হাজার চাকরিজীবীকে লে-অফের আওতায় জনতা ব্যাংকের ঋণ সুবিধায় জানুয়ারি পর্যন্ত বেতনাদি প্রদান করা হচ্ছে। সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এই বিশাল জনবলকে আর কোন প্রকার আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হবে না। যার প্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ১৬ টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাবে এবং সেখানে কর্মরত প্রায় ৪২ হাজার মানুষ চাকরি হারাবেন। সেই সাথে এই ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা সকল ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান,  স্কুল-মাদ্রাসা-কিন্ডার গার্ডেন বন্ধ হয়ে যাবে। যার সাথে পরোক্ষ প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ১০ লাখ মানুষ জড়িত আছে।

তিনি বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনুস সরকারের শাসন আমলে বেক্সিমকোর মত আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন এবং বাংলাদেশের সব চেয়ে বড় গ্রুপ বন্ধ হয়ে যায় তাহলে দারিদ্রতা বিমোচনে তাঁর কাঙ্খিত স্বপ্ন মুখ থুবরে পড়বে। ৪২ হাজার কর্মজীবি মানুষ চাকুরী হারাবে। তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় ২ লক্ষ পরিবারের সদস্য এবং এই শিল্প ও কর্মজীবিদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠা কর্মসংস্থানের আরো প্রায় ৮ লক্ষ মানুষের রিজিক বন্ধ হয়ে যাবে। যা শুধু উনার অভিশপ্ত দারিদ্রতাকেই বৃদ্ধি করবে না সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টি করবে। এই ৪২ হাজার কর্মজীবি মানুষের মাঝে প্রায় ২ হাজার প্রতিবন্ধী, শতাধিক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ এবং ৫ হাজারের মত ষাটোর্ধ ব্যক্তি রয়েছেন। সরকারের সিদ্ধান্তের যদি কোন পরিবর্তন না হয় তাহলে এরা সবাই মানবেতর জীবনের দিকে এগিয়ে যাবে। সেই সাথে প্রায় ৪২ হাজারের নতুন বেকার এবং ব্যবসা-বাড়ীভাড়া বঞ্চিত লাখো মানুষ নৈরাজ্য আর অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে গিয়ে নতুন সঙ্কট তৈরী করবে। তাই আমাদের প্রথম দাবী অবিলম্বে লে-অফ প্রত্যাহার করে আমাদের ১৬ টি বন্ধ কারখানা খুলে দেয়া হোক।

তিনি আরো বলেন, বেক্সিমকো গ্রুপের শুধু মাত্র বেক্সিমকো গার্মেন্টস ডিভিশনই আর্ন্তজাতিক বাজারে প্রতিমাসে প্রায় ৩০ লক্ষ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানী করে বাংলাদেশের রপ্তানী আয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করতো। আজ সেই গার্মেন্টস ও সংশ্লিষ্ট কারখানা গুলোকে বন্ধ এবং ব্যাংকিং সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখায় সরকার ও জনগন সেই বিশাল বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যা জাতীয় আয় ও রিজার্ভ ঘাটতির অন্যতম কারন। বর্তমান সময়ের উপযোগী মেশিনারিজ, প্রযুক্তি আর ৪২ হাজার দক্ষ জনবল নিয়ে তিল তিল করে গড়ে উঠা বেক্সিমকোর গার্মেন্টস শিল্প মরিচা ধরার অপেক্ষায় আছে। আমাদের মাসিক প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ পিস গার্মেন্টস তৈরীর সক্ষমতা, এশিয়ার বৃহত্তম ওয়াশিং প্লান্ট এবং অত্যাধুনিক মেশিনে সজ্জিত প্রিন্টিং, এমব্রয়ডারী ও এক্সেসসরিজ তৈরীর কাখানা, টেক্সটাইল মিল ও দক্ষ জনবল সকল বায়ারদেও প্রধান আকর্ষন। কম্পোজিট গ্রুপ হওয়ায় শুধুমাত্র তুলা ও ক্যামিক্যাল ক্রয় ছাড়া গার্মেন্টস তৈরীর অন্য কিছুই বাহির থেকে ক্রয় বা আমদানী করতে হয় না। এই সকল সুবিধা বেক্সিমকো ইন্ড্রাষ্ট্রিয়াল পার্কে বর্তমান থাকায় বায়াররা বেক্সিমেকোকে কার্যাদেশ দিতে সব সময় আগ্রহী থাকে। করোনা মহামারী ও ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধকালীন বৈশ্বিক সঙ্কটের মাঝেও বেক্সিমকো গার্মেন্টস ডিভিশণ গার্মেন্টস রপ্তানীতে শীর্ষস্থানে ছিল। এই রকম একটি লাভজনক, সুবিধা জনক এবং শ্রমঘন প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করে দিয়ে ১০ লক্ষ মানুষের মুখের খাবর কেড়ে নিলে তা জাতীয় প্রবৃদ্ধিও ব্যহত করবে। তাই অনুরোধ অবিলম্বে আমাদেও কারখানা গুলোকে খুলে দিয়ে ৪২ হাজার শ্রমিক কর্মচারী ও ১০ লক্ষ মানুষের খেয়েপড়ে বেঁচে থকার ব্যবস্থাটুকু নিশ্চিত করা হোক।

বেক্সিমকোর এসআর অ্যাডমিন ২য় দাবি তুলে ধরে বালেন, ব্যাংকিং ও এলসি সুবিধা ছাড়া দেশী-বিদেশী কোন ব্যবসা বাণিজ্য করা যায় না। অত্যান্ত পরিতাপের বিষয় যে, আজ ৬ মাস যাবৎ বেক্সিকোর গার্মেন্টস ডিভিশনের সকল ব্যাংকিং ও এলসি সুবিধা বন্ধ রাখা হয়েছে। একদিকে কারখানা বন্ধ, উৎপাদন নেই অন্যদিকে দায় দেনার পরিমান প্রচার করে তা পরিশোধের জন্য সকল প্রকার চাপ অব্যহত আছে। সেই প্রেক্ষিতে বলতে হয়-আয় থেকে দায় শোধ-ব্যাংকিং ও ঋণ ব্যবস্থাপনার মূলমন্ত্র যদি হয়ে থাকে তাহলে বেক্সিমকো গ্রুপের সকল দায়-দেনা নিয়মিত ভাবে পরিশোধের জন্য এর বন্ধ রাখা প্রতিটি কারখানা খুলে দিয়ে উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরুর করার কোন বিকল্প নেই। সেই সাথে প্রয়োজন আপনাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক বন্ধ থাকা ব্যাক টু ব্যাক এলসি ওপেন করে দেয়া। কিন্তু সব কিছু বন্ধ করে দিয়ে দায় পরিশোধের চাপ সৃষ্টি শুধু অমানবিকই নয়, অন্যায্যও বটে। এই দায় বহন করার সক্ষমতা কোন সরকারের বা ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। কারখানা বন্ধ রাখার প্রক্রিয়া যতই প্রলম্বিত হবে বেক্সিমকোর দায়ও তাতে বাড়তে থাকবে। তাই অবিলম্বে বায়ারদের কার্যাদেশ পাওয়ার সুবিধার্থে বেক্সিমকোর ব্যাংকিং সুবিধার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থা নিয়ে উৎপাদন শুরু করার মাধ্যমে সকল দায়-দেনা পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী করছি।

তিনি ৩য় দাবি তুলে ধরে বলেন, প্রতিষ্ঠানের কাছে শ্রমিকদের অর্জিত ছুটির ২ বছরের টাকা জমে গেছে এবং অফিসারদেও ৪ মাসের বেতনের টাকা বকেয়া রয়ে গেছে। বর্তমান আর্থিক দুরাবস্থার ভেতর এই বকেয়া গুলো পাওয়া গেলেও সন্তানদেও স্কুল-কলেজে ভর্তিও খরচটা মিটিয়ে ফেলা যেত। টাকার অভাবে সন্তানদেও নতুন বছওে, নতুন ক্লাসে ভর্তি করানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

অর্থসূচক/এএকে

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.