প্রতারণা, কারসাজিসহ প্লেসমেন্ট শেয়ার এবং প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) জালিয়াতির মাধ্যমে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুঁজিবাজার থেকে ১ লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে সদ্য প্রকাশিত বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
রবিবার (১ ডিসেম্বর) বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ৩ মাসের অনুসন্ধান শেষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করেছে সেখানে এসব তথ্য উঠে এসেছে ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজরে প্রভাবশালী উদ্যোক্তা গোষ্ঠী, ইস্যু ম্যানেজার, নিরীক্ষক ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কারসাজির একটি বড় নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। বাজারের মধ্যস্থতাকারী দেউলিয়া হয়েছে, তাদের ইক্যুইটি ৩০ হাজার কোটি টাকা নেতিবাচক হয়েছে।
যারা ব্যাংক খাতের অপরাধী, তারা পুঁজিবাজারে আস্থা নষ্ট করার পেছনেও ছিল বলে শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) একটি স্বার্থান্বেষী মহলের হস্তক্ষেপের কারণে নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
বিগত সরকারের শুরুর দিকে পুঁজিবাজার কারসাজি সম্পর্কে শ্বেতপত্রে বলা হয়, শক্তিশালী ব্যবসায়িক গোষ্ঠী ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা কীভাবে শেয়ারের দাম কারসাজির মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক ক্ষতি করে, তা এই বিপর্যয়ের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। জনরোষ এবং তদন্ত সত্ত্বেও এই কারসাজির পেছনের মূল খেলোয়াড়দের অনেকেই রাজনৈতিক সুরক্ষায় বিচার এড়িয়ে গেছেন।
পুঁজিবাজার থেকে ২০২০-২১ সালে বেক্সিমকো গ্রুপ বেক্সিমকো সুকুক বন্ডের মাধ্যমে ৩ হাজার কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করে। এই তহবিল সংগ্রহের সময় বলা হয়, তিস্তা সোলার ও করতোয়া সোলার নির্মাণ প্রকল্প, যা বেক্সিমকো লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এবং বেক্সিমকো টেক্সটাইল সম্প্রসারণে যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ব্যয় করা হবে। এই বন্ডের ক্রেতা রয়েছে এমন ধারণা পোক্ত করতে ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নির্দিষ্ট অঙ্কের বন্ড কিনতে বাধ্য করা হয়।
শ্বেতপত্রে পুঁজিবাজার কারসাজি বিষয়ে বলা হয়েছে, বেশ কিছু প্রভাবশালী বিনিয়োগকারী ও প্রতিষ্ঠান সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করে নিজেদের মধ্যে একের পর এক লেনদেন করে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়ায়। তারা ‘টার্গেটেড’ কোম্পানির শেয়ারের লেনদেন করে, যেখানে কিছু বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এমন বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনেন। এভাবেই ওই কোম্পানির শেয়ার লেনদেনের সক্রিয় চেহারা দেখানো হয়। বুক বিল্ডিং প্রক্রিয়ায় এমনভাবে কারসাজি করা হয়, যাতে কোম্পানির মূল্যায়ন বোঝা না যায়।
শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কিছু বড় মিউচুয়াল ফান্ড দখল করেছে। এ ক্ষেত্রে বিএসইসি অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। খায়রুল কমিশন বন্ধ থাকা মিউচুয়াল ফান্ডের সময়কাল অতিরিক্ত ১০ বছর বর্ধিত করে। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা তলানিতে নামে।
শ্বেতপত্রে আরো বলা হয়েছে, পুঁজিবাজারে সূচক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মার্জিন ঋণের অনুপাত বাড়ানোর নিয়ম করা হয়েছে। এর মাধ্যমে শেয়ারবাজারের উত্থানে ইন্ধন দেওয়া হয়। বিএসইসি প্রায়ই শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধিকে উপেক্ষা করে সূচক বজায় রাখার চেষ্টা করে। যখনই দাম কমতে শুরু করে, তখনই নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যকলাপ শুরু হয়। সবচেয়ে বিতর্কিত ফ্লোর প্রাইস পদ্ধতি আন্তর্জাতিকভাবে পুঁজিবাজারের সুনামকে কলঙ্কিত করেছে। এর মাধ্যমে ভালো কোম্পানির লেনদেন ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাজারে কারসাজিকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
শ্বেতপত্রে অভিযোগ করা হয়, অতীতে পুঁজিবাজার অনেক অসঙ্গতির সম্মুখীন হয়েছে, যা এই বাজার থেকে ইকুইটি সংগ্রহের ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। ফলস্বরূপ, বেসরকারি খাত ব্যাংক ঋণের উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল রয়েছে। পুঁজিবাজারে বিদেশী অংশগ্রহণও নগণ্য, প্রাথমিকভাবে দুর্নীতির চর্চা এবং স্বচ্ছতার অভাবের কারণে, বিশেষ করে কোম্পানির তথ্যের প্রাপ্যতা সংক্রান্ত উদ্বেগের কারণে। এর ফলে বাজারে মূলত দেশীয় বিনিয়োগকারীদের আধিপত্য রয়েছে।
স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার অভাবের কারণে এর মধ্যে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো কতটা সত্যিকারের লাভজনক তা নির্ধারণ করা কঠিন। এই স্বচ্ছতার অভাব বিনিয়োগকারীদের আস্থাকে ক্ষুন্ন করে এবং বাজারের বৃদ্ধিকে সীমাবদ্ধ করে।
অর্থসূচক/



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.