ব্যাংক ঋণে সুদহার বাড়লে কার লাভ কার ক্ষতি?

ব্যাংক ঋণের সুদহার বৃদ্ধি সাধারণত দেশের অর্থনীতিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সুদহার বৃদ্ধির ফলে ঋণ গ্রহণে খরচ বাড়ে। এর ফলে সরাসরি প্রভাব পড়ে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায়। এতে কিছু ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদে ব্যাংকগুলো লাভবান হলেও, সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির অন্যান্য খাত ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

দীর্ঘদিন ধরে দেশে মূল্যস্ফীতির উর্ধ্বগতি বজায় রয়েছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে ধারাবাহিকভাবে নীতি সুদহার বাড়াচ্চে বাংলাদেশ ব্যাংক। সবশেষ গত ২২ অক্টোবর নীতি সুদহার বা রেপো রেট দশমিক ৫০ শতাংশ পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ দশ‌মিক ৫০ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করবে, তার সুদহার বাড়বে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক আরও সংকোচনমূলক মুদ্রা সরবরাহের পথে হাঁটছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ার প্রভাব খুব বেশি প্রতীয়মান হবে দুটি ক্ষেত্রে। একটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি এবং আরেকটি বিনিয়োগ। এই দুই ক্ষেত্রেই সুদের হার বাড়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ইতিবাচক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

জানা গেছে, ব্যাংকঋণের সুদহারও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। সুদ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীল ছোট, মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ীদের কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে চলমান অস্থিরতায় অত্যাবশ্যকীয় নিত্যপণ্য নয় এমন পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। তাতে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের বিক্রিতে ধস নেমেছে। এমন পরিস্থিতিতে ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। সুদহার অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা সম্প্রসারণ ও নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনা আপাতত তুলে রাখছেন অনেক উদ্যোক্তা।

গত বছরের জুনেও ব্যাংকঋণের সুদের হার ছিল ৯ শতাংশ। বর্তমানে সেটি বাড়তে বাড়তে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ২২ অক্টোবর আরেক দফা নীতি সুদহার বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। এতে আরেক দফা ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়তে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে উদ্যোক্তাদের।

২০২০ সালের এপ্রিলে সরকারের পরামর্শে ব্যাংকঋণের সুদ সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় রেখে মেয়াদি আমানতের সুদহারও বেঁধে দেওয়া হয়, সে হার ছিল ৬ শতাংশ। এরপর দীর্ঘদিন ব্যাংক খাতে ঋণ ও আমানতের ক্ষেত্রে সুদহার ৯-৬-এ সীমাবদ্ধ ছিল। উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতি নানা সংকটে পড়লে গত বছরের জুলাইয়ে সুদের হার বাড়তে শুরু করে।

গত আগস্টে আহসান এইচ মনসুর গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার পর মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নীতি সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। এরই অংশ হিসেবে গত দুই মাসে দুই দফা নীতি সুদহার বাড়ানো হয়।

দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। বিদায়ী ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। এদিকে চলতি বছরও বিনিয়োগে সুখবর মিলছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ২৮ কোটি ৫০ লাখ ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৩ দশমিক ৭১ শতাংশ কম। এমনকি এই সময়ে প্রাথমিক কাঁচামাল আমদানি কমেছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সুদের হার কম থাকলে ব্যাংক ঋণ নিতে আগ্রহী হয় গ্রাহকরা। ফলে কম সুদে ঋণ নিলে বাজারে অর্থের যোগান বাড়ে। কিন্তু ব্যাংকে আমানত বা সঞ্চয় বাড়ে না। ফলে দেখা দেয় মূল্যস্ফীতি। এই মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতেই সুদের হার বাড়ানো হয়, যাতে ঋণ নিতে মানুষ কম আগ্রহী হয় এবং বাজারে অর্থের যোগান কমে।

গত মাসেও এ অঞ্চলে মূল্যস্ফীতির হার সবচেয়ে বেশি ছিল বাংলাদেশে। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে সার্বিক মূল্যস্ফীতি। এ অঞ্চলে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত পাকিস্তানেও এখন মূল্যস্ফীতির হার বাংলাদেশের চেয়ে কম। সুদহার বৃদ্ধি, পণ্য আমদানি ও বাজার নজরদারির মতো ব্যবস্থা নিয়েও বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না মূল্যস্ফীতি। এর মধ্যে নতুন করে শঙ্কা তৈরি করছে প্রতিবেশী ভারতে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। সেখানেও এখন মূল্যস্ফীতির হার ৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে।

অর্থসূচক/এমএইচ

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.