এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকাবস্থায় বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক (বিসিবি) থেকে নামে-বেনামে বিশাল অঙ্কের টাকা ঋণ নেওয়া হয়। যার বেশিরভাগ অর্থই আর ফেরত আসেনি। ফলে একপর্যায়ে তারল্য সংকটে পড়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি।
ব্যাংকটির এমন আর্থিক দুরবস্থায় পড়ার কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ ছাড়াও এস আলম গ্রুপের নিয়োগ দেওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের আগে তড়িঘড়ি করে ৩১৯ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার আদেশ জারি করে তৎকালীন পর্ষদ। এসব কর্মকর্তাই ব্যাংকটির ঋণ অনিয়মের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। তাদের পদোন্নতি বাতিলের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
একইসঙ্গে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকাবস্থায় প্রতিষ্ঠানটির নিয়োগ ও পদোন্নতির বিষয়ে একটি ফাংশনাল অডিট সম্পন্ন করা জরুরি বলেও মত দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৩৯৩তম সভার স্মারকের বিষয়ে এমন মতামত এসেছে সমন্বয়কের পক্ষ থেকে।
প্রসঙ্গত, ব্যাংকগুলোতে শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং আর্থিক অবস্থার দেখভাল করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সম্প্রতি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সমন্বয়ক/পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। আর্থিক কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন অনিয়মের কারণে গত ৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এবং এর কমিটিগুলো পুনর্গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে কমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখার দুই গ্রাহক স্মাইল অ্যাপারেলস লিমিটেড ও স্মাইল আউটফিট লিমিটেডের এলসি লিমিট ৩৯.৫০ কোটি ও ওডি লিমিট ৩.৯০ কোটি টাকা নবায়নের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। বিষয়টি তদারকি করার জন্যও সমন্বয়কের পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়েছে।
সেখানে আরও বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ১৫ শতাংশ এবং খেলাপির বিপরীতে ২০০ কোটি টাকা নগদ আদায়ের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। কিন্তু গত জুনে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৫৬ শতাংশ এবং খেলাপি থেকে নগদ আদায় হয়েছে মাত্র ২১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। যা ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনার চরম দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতার শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হবে না ব্যাংকটি।
গত ৩০ জুন পর্যন্ত ব্যাংকটিতে আমানতের পরিমাণ ছিল চার হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমানত ছিল চার হাজার ৬৯১ কোটি টাকা। একই সময়ে খেলাপি ঋণের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এ ছাড়া ব্যাংকটির বৃহদাঙ্ক ঋণের পরিমাণ ৯৫৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, যা মোট ঋণ ও অগ্রিমের (দুই হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা) ৪০.২৮ শতাংশ। ফলে ব্যাংকটির ঋণ কেন্দ্রীকরণ ঝুঁকি পরিলক্ষিত হচ্ছে— উল্লেখ করা হয় সমন্বয়কের মতামতে।
এ ছাড়া ব্যাংকটি ২০২৩ সালে নতুনভাবে ৬৪০ কোটি ৬১ লাখ টাকার ঋণ খেলাপি হয়েছে। যার বিপরীতে নগদ আদায় মাত্র ৮১ কোটি টাকা। একইসঙ্গে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে খেলাপি ঋণের কোনো উন্নতি হয়নি। অন্যদিকে, ঋণ পুনঃতফসিলের কিস্তি পরিশোধ না করায় ফের খেলাপিতে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে ব্যাংকটির তারল্য ও মূলধনসহ প্রধান আর্থিক সূচকগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠানো সুপারিশে সমন্বয়ক আরও উল্লেখ করেন, গত ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকটির ১১৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। এরপর থেকে চলতি হিসাব ঋণাত্মক হওয়ায় স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে ব্যাংকটি ব্যর্থ হচ্ছে। ব্যাংকটির তারল্যঝুঁকি বিবেচনায় ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এরপরও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গৃহীত রেপো সুবিধার শর্ত অনুযায়ী অর্থ পরিশোধ করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সিএসআর ও এসএলআর সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। তীব্র তারল্য সংকটের এমন অবস্থায় নতুন করে আরও এক হাজার কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা দিলে ব্যাংকটি ঋণের অর্থ সময় মতো পরিশোধ করতে ব্যর্থ হতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে।
করণীয় প্রসঙ্গে সমন্বয়কের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রক্ষিত অর্থ ফেরত আনা, ব্যাংকার ও গ্রাহক সম্পর্ক উন্নয়ন, ঋণ আদায় বিভাগ শক্তিশালীকরণ এবং কর্পোরেট সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে তারল্য ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার প্রতি কমার্স ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে জোর দিতে হবে। এমন প্রেক্ষাপটে ব্যাংকটির আর্থিক সূচকের অবনমন রোধ করা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতার শর্ত পরিপালন করতে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
ব্যাংকটির নির্বাহী/কর্মকর্তাদের পদোন্নতির বিষয়ে সমন্বয়কের মতামতে উল্লেখ করা হয়, চলতি বছরের ১৯ মার্চ ব্যাংকটির বিভিন্ন পদে ৩৪২ নির্বাহী/কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে ১৮ ও ২৫ আগস্ট বিভিন্ন পদে মোট ৩১৯ (১১৮ ও ২০১ জন) কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তড়িঘড়ি করে সর্বশেষ ধাপে দেওয়া পদোন্নতি (১৮ ও ২৫ আগস্ট) পুরো বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। দুর্বল ব্যবস্থাপনা কাঠামো ও ভঙ্গুর আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনায় পদোন্নতির এ অফিস আদেশ স্থগিত করার জন্য পর্ষদকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। এমন অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিল হয়েছে। কাজেই ব্যাংকটিতে মানবসম্পদের সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হলে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া পর থেকে প্রতিষ্ঠানটির মানবসম্পদ নিয়োগ ও পদোন্নতির বিষয়ে একটি ফাংশনাল অডিট সম্পন্ন করা জরুরি। বিষয়টি জরুরিভিত্তিতে বিবেচনার জন্য পর্ষদকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.