ভারতের বিজিপি সরকার ৩৭০ ধারা বিলোপের পর আগামী বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) ভারতের জম্মু-কাশ্মীরে বিধানসভার ভোট গ্রহণ শুরু হবে। টানা ৩৭ বছর ধরে ভোট বর্জন করে আসা জামায়াত ইসলামি’র নেতৃত্বাধীন জোট এবার বিধান সভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে।
রবিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগে ভারত সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ জামায়াত ইসলামি (জেআই) ও বিচ্ছিন্নতাবাদী জেলবন্দী জনপ্রিয় নেতা ইঞ্জিনিয়ার রশিদের হাতে গড়া আওয়ামি ইত্তেহাদ পার্টি (এআইপি) একসাথে ভোটের ময়দানে লড়ার জন্য রাজনৈতিক জোট গঠন করেছে।
দীর্ঘ ১০ বছর পর উপত্যাকায় হতে যাওয়া বিধানসভার নির্বাচনে মোট ৯০ টি আসনের মধ্যে জেআই ও এআইপি মোট ৪৩ আসনে প্রার্থী দিয়েছে। সবাই স্বতন্ত্র। কাশ্মীর উপত্যকায় ৪২ কেন্দ্রে এবং জম্মুতে একটিমাত্র কেন্দ্রে এই জোট লড়ছে। ভোট গ্রহণ চলবে ১ লা অক্টবর পর্যন্ত। ভোটের ফলাফল প্রকাশ করা হবে ৮ অক্টবর।
২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা রহিতের পর হতে চলা প্রথম নির্বাচন ঘিরে উপত্যাকায় ব্যপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। জেআেই ও এআইপি জোট বিধানসভার নির্বাচনে চমক দেখাবে বলে দলটির নেতারা আশা করছে।
১০ বছর আগের তুলনায় এবারের ভোট–চরিত্র পুরোপুরি আলাদা। দীর্ঘ সময় ক্রামগত ভোট বর্জনের পর এই প্রথম জামায়াতে ইসলামির (জেআই) সাবেক নেতারা জোটের পার্থী হয়ে বিধানসভার ভোটে নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষায় নেমে পড়েছেন। সেই সিদ্ধান্ত জন্ম দিয়েছে বহু অভিযোগ ও প্রশ্নের। উপত্যকার রাজনৈতিক নেতাদের ধারণা, ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে এটা বিজেপির নবতম চাল।
জম্মু–কাশ্মীরে জামায়াত শেষবার নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিল ১৯৮৭ সালে। বিধানসভার সেই ভোট এখনো কারচুপির জঘন্যতম নিদর্শন বলে চিহ্নিত। সেই ভোটে জামায়াত লড়েছিল মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্টের (এমইউএফ) ব্যানারে। প্রবল আশা ও প্রচুর উদ্দীপনা সত্ত্বেও সেবার জামায়াতের প্রার্থীরা জিতেছিলেন মাত্র ৪টি আসন, যদিও মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্ট ভোট পেয়েছিল ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ। তাদের চেয়ে মাত্র ১ শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে কংগ্রেস সেবার জিতেছিল ২৬টি আসন, ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) পেয়েছিল ৪০টি আসন। এনসি পেয়েছিল প্রায় ৩৩ শতাংশ ভোটারের সমর্থন।
পরে জামায়াত যোগ দিয়েছিল হুরিয়ত কনফারেন্সের সঙ্গে। ডাক দিয়েছিল ভোট বর্জনের। একসময় নিষিদ্ধও ঘোষিত হয় জামায়াত, এখনো নিষিদ্ধ। সম্প্রতি সেই নিষেধাজ্ঞা বাড়ানো হয়েছে ২০২৯ সাল পর্যন্ত। অথচ সরকারি উৎসাহ, উদ্যোগ ও মদদেই এবার তারা নির্বাচনের শরিক—যদিও নিজেদের সংগঠনের ব্যানারে নয়, স্বতন্ত্র হিসেবে। বিতর্ক সৃষ্টি করেছে সেই সিদ্ধান্তই।
আগ্রহ ও উত্তেজনার আরও এক কারণ কারাবন্দী ইঞ্জিনিয়ার রশিদ দিল্লির তিহার জেলে বন্দী থেকেও লোকসভা ভোটে হারিয়ে দেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও এনসির সহসভাপতি ওমর আবদুল্লাহকে। ২ লাখের বেশি ভোটে তাঁর জয় উৎসাহিত করেছে জামায়াত ও এআইপি জোটসহ অন্যদের, যারা প্রথাসিদ্ধ রাজনীতির বিরোধিতা করার কারণে মূলধারার রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে এত বছর।
ভোটের ঘোষণার পর জামায়াত জোট এতোদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালাচ্ছিল। গতকাল রোববার শ্রীনগরে আবদুল্লাহ পরিবারের ‘খাসতালুক’ বলে পরিচিত গান্দারবাল নির্বাচনী কেন্দ্রের বোগাম গ্রামে তারা প্রকাশ্য সমাবেশ করে। সেখানে জনসমাগম ছিল বিস্ময়কর। এই সমর্থনই তাঁদের শক্তি জানিয়ে জামায়াতের স্বতন্ত্র প্রার্থী সায়াদ আহমেদ রেশি বলেন, কিছু মানুষ এখনো তাঁদের দিকে আঙুল তুলবেন। তাঁদের এতকালের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। কিন্তু তাঁরা বাস্তবতার দিকে তাকিয়েই ভোটে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, এতোকালের প্রথামাফিক রাজনীতি একটা গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। সেই শূন্যতা ভরাট করাই তাঁদের লক্ষ্য।
জামায়াতের নেতারা জানিয়েছেন, উপত্যকার মানুষের সম্মান প্রতিষ্ঠায় যাঁরা কাজ করবেন, তাঁরা সেই দলকেই সমর্থন করবেন।
প্রশ্ন উঠেছে, যাঁরা এতোকাল উপত্যকায় রক্তপাত ঘটিয়েছেন, তাঁদের কী করে কেন্দ্রীয় সরকার মদদ দেয়? কোন লক্ষ্যে? কী উদ্দেশ্যে?
বিজেপি সরকারিভাবে ওই অভিযোগ অস্বীকার করছে। অস্বীকার করছেন ইঞ্জিনিয়ার রশিদ ও জেআই নেতৃত্বও। কিন্তু তা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না দুটি কারণে। প্রশ্ন উঠছে, সংসদীয় অধিবেশনে যোগ দেওয়ার সাংবিধানিক অধিকার যে আদালত নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে (রশিদ) দেননি, তাঁকে কেন নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে জামিন দেওয়া হলো? উত্তরটাও তাঁরা দিচ্ছেন, বিজেপি চাইছে বলে।
দ্বিতীয় কারণ, জামায়াতে ইসলামি যাতে ভোটে লড়তে পারে, সে জন্য তাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জেআই নেতাদের চারবার বৈঠক হয়েছিল। সেই বৈঠকে যোগ দিয়েছিল জেআইয়ের আট সদস্যের প্রতিনিধিদল। তাদের নেতা গুলাম কাদের ওয়ানি উদ্যোগী হয়ে শেষবেলায় এই জোট গড়েছেন। কেন গড়লেন? তারও উত্তর দিচ্ছেন এনসি নেতারা, সরকার চাইছে বলে।
ওমর আবদুল্লাহরাও প্রতিটি জনসভায় এই প্রশ্নই তুলে যাচ্ছেন। বিজেপির উত্তর, অস্ত্র ছেড়ে যাঁরা রাজনীতির মূলধারায় ফিরতে আগ্রহী, তাঁদের সুযোগ দেওয়া উচিত।
ভবিষ্যৎ যা–ই হোক, ১৮ সেপ্টেম্বর প্রথম পর্বের ভোট শুরুর আগে উপত্যকায় আগ্রহ ও উত্তেজনা তুঙ্গে উঠেছে। ভোটের মাঠে বড় ধরণের চমক সৃষ্টি করে জামায়াত জোট উপত্যাকায় সরকার গঠনের অংশ হয়ে উঠতে পারে।
অর্থসূচক/এএকে



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.