‘কিছু নির্মম ইতিহাস টাইমলাইনে থাকুক’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে একটা পর্যায়ে সাধারণ জনতা অংশগ্রহণ করেন। বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের অংশগ্রহণের এই আন্দোলনে সংস্কৃতিকর্মীদের অংশগ্রহণও ছিল। তরুণ সংগীতশিল্পী তাসরিফ খান আন্দোলন চলাকালে ‘রাজার রাজ্যে সবাই গোলাম’ শীর্ষক পুরোনো গানের সঙ্গে প্রতিবাদ জানান। আন্দোলনে সমর্থনের কারণে গত জুলাইয়ে মানসিক নির্যাতনের শিকার হন বলে জানান তাসরিফ। তাঁর ব্যান্ডের ড্রামার শান্তকে বেধড়ক পেটানো হয়, সেই ঘটনার বর্ণনা ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন।

তাসরিফ খান তাঁর ফেসবুকে ‘কিছু নির্মম ইতিহাস টাইমলাইনে থাকুক’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ লেখা লিখেছেন। সেখানে তিনি জানান, ছাত্রদের পক্ষে বিভিন্ন পোস্ট দেওয়া, কবিতা লেখা এবং ‘রাজার রাজ্যে সবাই গোলাম’ গানটা ফেসবুকে প্রকাশ করার কারণে সরকারি গুন্ডা বাহিনীর হুমকিতে ৫ জুলাই থেকে বাসার বাইরে ছিলেন।

ঘটনাটি ২৩ জুলাই রাত ১টার কথা উল্লেখ করে তিনি শুরুতে লিখেছেন, ‘একজন সিনিয়র ইনফ্লুয়েন্সার কল দিয়ে বললেন, “তাসরিফ, তোর বাসার নিচে নাম, চা খাইতে আসতেছি, গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে।” ওই ইনফ্লুয়েন্সারের কথায় বিশ্বাস করে, আমি তখন বাসার সামনে আসি, দেখা করতে। গাড়ি থেকে ছয়-সাতজনের মতো নেমে আসেন। ইনফ্লুয়েন্সার আমাকে পাশে নিয়ে আস্তে করে বুঝিয়ে বলেন, “সাথে যাঁরা আছেন, তাঁরা একটা এজেন্সির লোক এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বাহিনীর কয়েকজনও আছেন এখানে।”

আমি তখন তাঁর কাছে জানতে চাই যে ‘তাঁরা কেন এসেছেন, কী চাচ্ছেন মূলত! তিনি তখন বুঝিয়ে বলেন, ‘সরকারি একটা কাজ আছে, এই সরকার আরও সাত-আট বছর ক্ষমতায় থাকব। আমরা ঠিকমতো বাঁচতে চাইলে সরকারের পক্ষে কাজ করতে হবে, এর বাইরে কোনো রাস্তা নাই।’

এই কথা বলে তিনি আবার আমাকে গাড়ির কাছে নিয়ে যান। সেই ছয়-সাতজনের মধ্য থেকে একজন আমাকে বলেন, ‘তাসরিফ, তোমাকে আমরা চিনি। আমরা তোমাকে একটা স্ক্রিপ্ট দিচ্ছি, ছোট্ট একটা ভিডিও করতে হবে। এই ভিডিওটা আমাদের কালকের মধ্যে লাগবে। পরশু সরাসরি প্রধানমন্ত্রী এই ভিডিওটা দেখবে এবং তারপর তুমি আপলোড করবা।’

সেই ইনফ্লুয়েন্সার তাঁদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমাকে বলেন, ‘দেখ তাসরিফ, প্রধানমন্ত্রীর চোখে পড়ার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। ভিডিওটা ভালো করে কর, সরকার যত দিন আছে, সুবিধা পাবি।’ কথা শেষ করার আগেই তিনি পকেট থেকে এক লাখ টাকার তিনটা বান্ডিল আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এইটা সামান্য ছোট একটা গিফট! টাকা যত চাস, তত দেওয়া হবে, ভিডিওটা সুন্দর কইরা কর।’

এরপর তাসরিফ এও লিখেছেন, ‘ঠিক এই সময় মোবাইলে আমারই ব্যান্ডের ড্রামার শান্তর নম্বর থেকে একটা কল আসে। ফোন রিসিভ করতেই শান্ত কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘তাসরিফ! পাঁচ–ছয়জন পুলিশ এবং সিভিল ড্রেসের কয়েকজন মিলে আমাকে রোল দিয়া সারা শরীরে মারছে!’ শান্তর কথা শুনে আমার হাত-পা কাঁপতে থাকে। বোঝার চেষ্টা করি, এই মাইর খাওয়া কি আমাকে এদিকে রাজি করানোর জন্য ভয় দেখানো? নাকি শুধুমাত্র একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা? শান্তর লাইন কেটে যায়।

আমি আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয় দেওয়া তাদের বলি, ‘ভাই, এইমাত্র কয়েকজন মিলে আমার ভাই, আমার ব্যান্ডের ড্রামার শান্তকে প্রচুর মারছে! ওরা জাস্ট আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘আরে! দেশের যে অবস্থা, এখন কিছু করা যাবে না। ওরে বলো বাসায় চলে যাইতে।’ আমার তখন মাথায় আসে, এখন যদি আমি তাঁদের টাকা ফিরিয়ে দিই অথবা কাজ করতে অস্বীকৃতি জানাই, তবে তাঁরা চাইলেই আমাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে ভিডিও করে জোরপূর্বক আপলোড করাতে পারেন। তাই মাথা ঠান্ডা করে তাঁদের বলি, ঠিক আছে আমি দেখছি, কী করতে পারি। কালকের মধ্যে জানাচ্ছি। তাঁরা আমাকে তখনো একরকম হুমকি দিয়ে বলেন, ‘জানাচ্ছির সুযোগ নাই! অবস্থা তো বোঝেনই। ভিডিও কালকেই লাগবে।’ সঙ্গে ওই ইনফ্লুয়েন্সারও আমাকে বলেন, ‘তাসরিফ, ভিডিওটা তো পিএম দেখবে, সো বুইঝা–শুইনা সুন্দর কইরা করিস।’

পোস্টে তাসরিফ উল্লেখ করেন, রাতে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বাসায় যান। এরপর চিন্তা করতে থাকেন, কী করবেন। পরিস্থিতি সামাল দেবেন কীভাবে। সেই ঘটনার বর্ণনার দিয়ে তাসরিফ লিখেছেন, ‘বাসায় ফিরে সবাইকে সব অবস্থা জানিয়ে আমার ম্যানেজার আয়মান সাবিতকে ফোন দিয়ে বলি,‘আয়মান, আমি বাসা ছেড়ে দিচ্ছি, এই এই ঘটনা ঘটছে। আমি তোকে নম্বর দিচ্ছি, তুই ওই এজেন্সিকে আমার বাসা থেকে তিন লাখ টাকা নিয়ে দিয়ে দিবি, কালকেই। আমি আপাতত বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি; কারণ, আমি বাসায় থাকলে ওরা আমাকে তুলে নিয়ে যাবে।’ ওই সময় আমার মনের অবস্থা আমি জানি। আমার বাসার অবস্থা—ডায়াবেটিসের রোগী আমার আম্মু, আব্বুর টেনশন, গুম হয়ে যাওয়ার চিন্তা এবং দেশের সঙ্গে বেইমানি করতে ওরা আমাকে বাধ্য করতে চাচ্ছে, সবকিছুই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সঙ্গে বারবার আমার কানে বাজছে শান্তর ওই আর্তনাদ।’

পোস্টের একেবারে শেষে ২৩ জুলাই রাতে পালিয়ে যাওয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন তাসরিফ। তিনি লিখেছেন, ‘ওই রাতে আমি বাসা থেকে পালিয়ে যাই। আমি জানি কয়েকটা পোস্ট, কবিতা লেখা আর ‘রাজার রাজ্যে সবাই গোলাম’ এর মতো কিছু গান করা ছাড়া, দেশের জন্য তেমন কিছুই করতে পারিনি। আমি জানি, আমি আবু সাঈদের মতো পথে গিয়ে বুক পেতে দিতে পারিনি। হয়তোবা এতটুকু সাহস আমার তখন হয় নাই। তবে আল্লাহ জানেন আর আমি জানি, আমি টাকার কাছে বিক্রি হয় নাই আর দেশের সঙ্গে বেইমানি করি নাই।’

অর্থসূচক/

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.