রেসের নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত শুরু

ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারের বহুল আলোচিত চরিত্র চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাথমিক পর্যায়ে সংস্থাটি পদ্মা ব্যাংক দখল ও শেয়ারবাজার থেকে অর্থ লোপাটের মাধ্যমে ৮০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে।।

দুদক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে ব্যাংক ও শেয়ারবাজার থেকে নানা কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া অভিযোগ আছে। তিনি আর্থিক খাত ও শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা। এই দুই খাত ছাড়াও মোবাইলের টাওয়ার কোম্পানি, বিদ্যুৎ কোম্পানি, তারকা হোটেল ব্যবসা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, গণমাধ্যমসহ নানা খাতে তার বিনিয়োগ আছে।

চৌধুরী নাফিজ সরাফাত পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) সাবেক চেয়ারম্যান। ব্যাংকটির অন্যতম উদ্যোক্তা-শেয়ারহোল্ডারও তিনি। তিনি ব্যাংক বহিঃর্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্সের প্রধান উদ্যোক্তা।

দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি রেস প্রাইভেট লিমিটেডের অন্যতম কর্ণধার। এই কোম্পানি ১০টি মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনা করছে, যার তহবিলে আকার প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। প্রসপেক্টাস ও আইন অনুসারে, ফান্ডগুলোর সর্বোচ্চ মেয়াদ ১০ বছর। কিন্তু শেয়াদ শেষ হওয়ার হওয়ার এগুলোর অবসায়ন হয়নি। প্রভাব খাটিয়ে এগুলোর মেয়াদ আরও ১০ বছর বাড়ানো হয়েছে।

অন্যদিকে বিধিবিহর্ভূতভাবে বিএসইসির অনুমোদন না নিয়ে এসব ফান্ডের টাকায় চৌধুরী নাফিজ সরাফাত আলোচিত পদ্মা ব্যাংকের শেয়ার কিনে পরিচালক বনেছেন। এছাড়া মাল্টি সিকিউরিটিজ নামে একটি ব্রোকারহাউজও কেনা হয়েছে এসব ফান্ডের টাকায়।

পুলিশের একজন সাবেক আইজি ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিদের সহায়তা নিয়ে তিনি শুধু ব্যাংক, শেয়ারবাজার ও অন্যান্য খাতে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। তার কাছে বিএসইসি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকও ছিল অনেকটা জিম্মি।

সাবেক ফারমার্স (বর্তমানে পদ্মা) ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে ২০১৭ সালে পদ ছাড়তে বাধ্য হন ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। এরপরই ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংকটির নাম পাল্টানো হয়। নাম দেওয়া হয় পদ্মা ব্যাংক।

তীব্র তারল্য সঙ্কটে বন্ধ হবার পথে থাকা পদ্মা ব্যাংক বাঁচাতে তিনি রাষ্ট্রীয় মালিকানার জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও আইসিবিকে পদ্মা ব্যাংকের ইক্যুইটিতে বিনিয়োগে বাধ্য করেন তিনি। ওই ব্যাংকে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান বড় অংকের আমানত রেখে ফেঁসে গেছে।

চৌধুরী নাফিজ সরাফাত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দণ্ড-সুদ, জরিমানা মওকুফসহ বিভিন্ন ছাড় পায় পদ্মা ব্যাংক। এরপরও ব্যাংকটি ধুঁকছে। ২০২৩ সালের শেষে পদ্মা ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণই ৩ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। ফলে ঋণ থেকে যে আয় হয়, তা দিয়ে আমানতের সুদ পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। ব্যাংকটি বড় অর্থের লোকসান গুনছে বলে জানা গেছে।

অবশ্য চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত।

নাফিজ সরাফাত একাধিক ব্রকারহাউজের মালিক। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সর্বশেষ যেসব ট্রেক ইস্যু করেছে, তাতে নামে-বেনামে নাফিজ সরাফাতের ৩/৪টি ট্রেক রয়েছে।

গত বছর তার বিরুদ্ধে জোর করে একটি টেলিভিশনের শেয়ার লিখে নেওয়ার আভিযোগ করেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেদ সভাপতি ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান।

তিনি এক লিখিত বক্তব্য বলেন, তাকে গভীর রাতে বাসা থেকে একজন (চৌধুরী নাফিজ সরাফাত) বেনজীরের কাছে নিয়ে যান। এরপর (সিটিজেন টিভির) শেয়ার লিখে নেয়া হয়। চার-পাঁচ বছর আগে সংসদ সদস্য শফিকুর রহমানকে রাতে তার বাসা থেকে তুলে হোটেল ওয়েস্টিনের নিচ তলায় বেনজীরের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে রুট গ্রুপের মালিক রাজ্জাকুল হোসেন টুটুল, নাফিজ সরাফাতসহ আরও দুজন উপস্থিত ছিলেন।

এই বেনজীর হচ্ছেন পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ। যার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে শত শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে।

শফিকুর রহমান আরও বলেন, এক পর্যায়ে বিভিন্নভাবে ব্লাকমেইল ও প্রতারণার মাধ্যমে শফিকুর রহমানের সই নিয়ে সিটিজেন টিভির শেয়ার হস্তান্তর করে নেয়া হয়। পরে শফিকুর রহমান জানতে পারেন তার নামে সিটিজেন টিভির ৩০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে এবং বেনজীরের দুই মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে যথাক্রমে ১৫ শতাংশ করে মোট ৩০ শতাংশ শেয়ার, আরেকজনের নামে (অজ্ঞাত) ২৫ শতাংশ শেয়ার এবং টুটুনের নামে রয়েছে ১৫ শতাংশ শেয়ার। শফিকুর রহমানের ভাষ্যমতে চার-পাঁচ বছর পার হলেও তিনি এ বিষয়ে কিছু করতে পারেননি।
গত বছরের ২৩ জুন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম. সরোয়ার হোসেন সিটিজেন টিভিকাণ্ডে সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান ও চৌধুরী নাফিজ সরাফাতসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেন।
  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.