পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান হিসেবে ড. এম মাসরুর রিয়াজের নিয়োগ ঝুলে গেছে। গতকাল মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) তাকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া হলেও তিনি এখন পর্যন্ত অফিস করেননি।
গতকালই গণমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাত না করে তিনি বিএসইসিতে যোগ দেবেন না। তবে যোগ দেওয়ার আগেই কেন তিনি উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাত করতে চান, তাঁর সঙ্গে কী কথা বলবেন তিনি, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা দেননি।
এদিকে খোদ তার নিয়োগকর্তা অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে নিয়োগের প্রজ্ঞাপনটিই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, তার বিষয়ে কিছু অভিযোগ ওঠায় বিষয়টি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের নির্দেশে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে মাসরুর রিয়াজকে বিএসইসির চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, মাসরুর রিয়াজের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে বিএসইসির চেয়ারম্যান নিয়োগ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, তার (মাসরুর রিয়াজ) বিষয়ে কিছু প্রশ্ন আছে। সে বিষয়টি আমি দেখবো। দেখে দু-একদিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবো।
মাশরুর রিয়াজকে নিয়ে যেসব আভিযোগঃ
সালমান এফ রহমানের আস্থাভাজনঃ
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাধিক এক্টিভিস্ট দাবি করেছেন, মাশরুর রিয়াজ পতিত আওয়ামীলীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের ঘনিষ্ট । সরকারের বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আয়োজিত বিভিন্ন সেমিনারের তিনি সরকারের ফরমায়েসি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। এমনকি মাশরুর রিয়াজের নিজের প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ আয়োজিত বিভিন্ন সেমিনারেও তিনি সরকারের বয়ানের সঙ্গে মিল রেখে অর্থনীতির সুন্দরচিত্র (Rosy Picture) ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন। কিন্তু অর্থনীতিতে চলমান দুর্বৃত্তায়ন, অরাজকতা, ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারে সংঘটিত লুটতরাজের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলেননি, কোনো তথ্য উপাত্ত দেননি। অগ্রাধিকার বিবেচনা না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া সরকারেরর বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন, কিন্তু সেগুলো থেকে যে রিটার্ন আসবে, সে বিবেচনায় প্রকল্পগুলো লাভজনক কিনা জোরালোভাবে ওই প্রশ্ন তুলেননি। প্রকল্পগুলো যে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল, বড় প্রকল্পের আড়ালে যে বড় লুটপাট হচ্ছে-সে বিষয়গুলোও তিনি সব সময় এড়িয়ে গেছেন।
আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা শুরু থেকেই দাবি করে আসছেন, শুধু সরকার পরিবর্তন নয়, সরকার সংস্কার হচ্ছে তাদের প্রধান লক্ষ্য। আওয়ামীরীগ সরকারের গত ১৫ বছরের মেয়াদে অবাধে যে লুটপাট হয়েছে, সেগুলোরও বিচার করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এমন লুটপাটের সাহস কেউ না করেন। পতিত সরকারের উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারে ব্যাপক লুটতরাজের আভিযোগ আছে। তাই তার মতো ঘনিষ্ট কোনো ব্যক্তি বিএসইসির চেয়ারম্যান হলে তার বিচার করা সম্ভব হবে না, হলেও তা হবে লোকদেখানো এবং আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে খোদ বিএসইসি তাকে দায়মুক্তির সুযোগ করে দিতে পারে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সব-সমন্বয়ক মোসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ গতকাল মাশরুর রিয়াজের নিয়োগের প্রজ্ঞাপনের আগে ফেসবুকে লিখেছেন, সালমান এফ রহমানে নিজস্ব লোককে বিএসইসি চেয়ারম্যান বানাচ্ছেন বলে আভিযোগ পাচ্ছি। তিনি তাকেসহ তার নিয়োগকর্তাদের প্রতিহত করার হুমকী দেন।
শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সঙ্গে মাখামাখিঃ
বিএসইসির সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সঙ্গেও মাশরুর রিয়াজের ব্যাপক সখ্য আছে বলে অভিযোগ আছে। বিএসইসি ও সালমান এফ রহমানের নিয়ন্ত্রণাধীন বিডার যৌথ উদ্যোগে গত চার বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোড শো বা বিনিযোগ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। এর কয়েকটিতে মাশরুর রিয়াজকে প্রবন্ধকার হিসেবে নিয়ে যাওয়া। তার সব ব্যয় বহন করেন আয়োজকরা। এমন অবস্থায় তিনি সালমান এপ রহমান ও শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত চালানো ও ব্যবস্থা নিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রজ্ঞাপন জারির পরও মাশরুর রিয়াজকে এখনই বিএসইসিতে যোগ না দেওয়ার জন্য মৌখিখভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের বিরুদ্ধে বাজারে একটি চিহ্নিত কারসাজি চক্রকে প্রশ্রয় দেওয়া, তাদের সঙ্গে যোগসাজশ, দুর্বল কোম্পানির আইপিও অনুমোদন, রাইট শেযার ও বন্ড অনুমোদনে অস্বচ্ছতা, ওটিসি মার্কেটের বিভিন্ন কোম্পানিকে কৌশলে মূলবাজারে নিয়ে এসে তার ঘনিষ্ট মানুষদের বিপুল অর্থ কমানোর সুযোগ দেওয়া; সুকুকসহ নানাভাবে নানা কৌশলে সালমান এফ রহমানের শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি রোড শো’র নামে বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচারের সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে, যদিও বিভিন্ন সময়ে তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন কর্মকর্তা অর্থসূচককে বলেন, পুঁজিবাজার অত্যন্ত স্পর্শ কাতর। কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে বিতর্ক আছে, এমন কাউকে এই বাজারের রেগুলেটরের দায়িত্ব না দেওয়া-ই ভাল। তবে মাশরুর রিয়াজ সম্পর্কে যে আভিযোগগুলো উঠেছে, সেগুলো কতটুকু সঠিক সে বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই বলে স্বীকার করেন তিনি। তিনি বলেন, অভিযোগগুলো যদি অসত্য হয়, তাহলে তার নিয়োগ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনটি কার্যকর হবে। আর যদি কিছুটাও সত্যতা পাওয়া যায় তাহলে সরকার নিশ্চয়ই তা পুনর্বিবেচনা করবেন।
অভিযোগগুলোর বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য মাশরুর রিয়াজকে ফোন করা হলেও, তা তিনি রিসিভ করেননি। তার হোয়্যাটসঅ্যাপে ম্যাসজ পাঠানোর পরও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.