হঠাৎ প্রধান বিচারপতি ফুল কোর্ট সভা ডেকেছিলেন কেন?

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কী অবৈধ ঘোষণা করা হতো?

আকষ্মিকভাবে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের (হাইকোর্ট বিভাগ ও আপীলাত বিভাগ) বিচারপতিদের নিয়ে ফুল কোর্ট সভা ডেকেছিলেন সদ্য পদত্যাগকারী প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। দেশের ক্রান্তিকালীন এই পরিস্থিতিতে এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তিনি আইন ও বিচার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টার সঙ্গে প্রাথমিক কোনো আলোচনা করেননি। তার এই উদ্যোগকে ঘিরে এখন নানা প্রশ্ন। বলা হয়েছিল, ওই সভার উদ্দেশ্য- বন্ধ থাকা বিচারবিভাগের কার্যক্রম চালু করার বিষয়ে আলোচনা। তবে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ও সমর্থকসহ দেশের সাধারণ মানুষও বিষয়টিকে এত সরল মনে করছেন না। অনেকেই এর পেছনে দেশীয় অথবা আন্তঃরাষ্ট্রীয় কোনো ষড়যন্ত্রের যোগসাজস থাকতে পারে বলে মনে করছেন।

আজ শনিবার সকাল ১০টায় এই সভা অনুষ্ঠানের কথা ছিল। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তীব্র প্রতিবাদের মুখে পরে তা বাতিল করা হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে বিদায় নিতে হয়েছে। প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন তিনি।

ওবায়দুল হাসানের এই তৎপরতার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে এর আগে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের একটি বক্তব্যের সঙ্গে এর সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। ওই সাক্ষাতকারে জয় দাবি করেন, তার মা শেখ হাসিনা ভারতে যাওয়ার আগে পদত্যাগ করেননি। এখনো তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবৈধ।

এমনিতেই বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক ছিল। দায়িত্বে থাকাকালীন মেয়াদে সব সময় তিনি বিদায়ী আওয়ামীলীগ সরকারের অনুগ্রহপ্রার্থী ছিলেন-এটা তারা নানা কাজকর্মে স্পষ্ট হয়েছে। বিনিময়ে সরকারকেও দিয়েছেন নানা সুবিধা। এসব কারণে গত ৫ আগস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর থেকেই আন্দোলনকারীরা তার পদত্যাগ চেয়ে আসছিলেন।

মূলতঃ আওয়ামীলীগ সরকারের সঙ্গে অতি ঘনিষ্টতা ও নানা কর্মকাণ্ড তাকে নিয়ে নানা সন্দেহ ও অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল। তার পরিবার দীর্ঘ দিন ধরে আওয়ামীলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ওবায়দুল হাসানের বাবা প্রয়াত আখলাকুল হোসাইন আহমেদ ১৯৭০ সালে আওয়ামীলীগের মনোনয়নে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর ভাই সাজ্জাদুল হাসান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিব ও সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সর্বশেষ জাতীয় সংসদে আওয়ামীলীগ মনোনীত সংসদ সদস্য ছিলেন।

ওবায়দুল হাসান প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার পর ছাত্রলীগ তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। এছাড়া বিতর্কিত পুলিশ অফিসার ডিবির সাবেক ডিসি হারুণ তাকে স্বর্ণের তলোয়ার উপহার দিয়েছিল। কোনো বিচারপতির এভাবে শুভেচ্ছা ও উপহার গ্রহণের রীতি নেই। এছাড়া ওবায়দুল হাসান বিচারপতির দায়িত্বে থাকাকালীন সময়েও দেশের বাইরে গেলে আওয়ামীলীগ নেতাদের বাসায় অবস্থান করতেন বলে অভিযোগ আছে।

গত ১৮ জুন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের প্রজ্ঞাপনকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেওয়ার পর ফের কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে বিচাপতি ওবায়দুল হাসান প্রশ্ন তুলেছিলেন, আন্দোলন করে রায় পরিবর্তন করা যায় কিনা। সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে আদালতের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই জেনেও তিনি হাইকোর্টের ওই রায়কে সমর্থন করেছেন। সরকার ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করেছিল। কোটা সংস্কার নিয়ে গত ৪ জুলাই প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, হাইকোর্টের দেওয়া রায় নিয়ে আপিল বিভাগের শুনানিতে বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘এত আন্দোলন কিসের রাস্তায় শুরু হয়েছে? আন্দোলনের চাপ দিয়ে কি হাইকোর্টের রায়, সুপ্রিম কোর্টের রায় পরিবর্তন করবেন?’

কোর্ট ওই আপীর আবেদনের পরবর্তী শুনানীর দিন ধার্য করেছিল ১৩ আগস্ট। আন্দোলনের তীব্রতা বিবেচনায় শুনানীর তারিখ এগিয়ে আনতে পারতেন তৎকালীন প্রধান ওবায়দুল হাসান। তাতে পরবর্তী সংঘাত ও রক্তপাত এড়ানো যেত। কিন্তু তা করেননি।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পরও বিচারবিভাগ, সেনাবিহনী ও প্রশাসনের একটি অংশ নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল বলে বার বার অভিযোগ উঠেছে। অনেকে আজকে সরকারের সঙ্গে আলোচনা না করে হঠাৎ ফুলকোর্ট সভা আহ্বানকে ওই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সন্দেহ করছেন। বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে তার মা পদত্যাগ করেনি এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবৈধ দাবি করার পর পরই আলোচিত সভা আহ্বান করায় মানুষের মনে সন্দেহ বেড়ে যায়। অনেকেই আশংকা করছিলেন, ফুল কোর্ট সভাটি করতে পারলে ওই সভা থেকে হয়তো অন্তর্বর্তী সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করা হতো। এর পরপরই দেশে জরুরী অবস্থা জারি করতেন রাষ্ট্রপতি মোহঃ সাহাবুদ্দিন। সুপ্রীম কোর্টের সব বিচারপতিই বিদায়ী আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত। তাই ফুলকোর্ট সভায় অন্তর্বর্তী সরকারকে অবৈধ ঘোষণার মতো প্রস্তাব সহজেই পাস হয়ে যেতো। অন্যদিকে মোঃ সাহাবুদ্দিনকে অন্ধ আনুগত্য বিবেচনাতেই রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়। বিতর্কিত এই ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় লুটেরা এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ইসলামী ব্যাংকে ভাইস-চেয়ারম্যান ছিলেন। বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ মনোনীত সাহাবুদ্দিন যে সুযোগ পেলেই আওয়ামীলীগের পক্ষে যে কোনো ষড়যন্ত্র করতে পারে তা নিয়ে আশংকা করার যথেষ্ট কারণ আছে।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.