বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল (ইউসিবি) ব্যাংক নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারনে আর্থিক দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ব্যাংকটিকে পারিবারিক বলয় থেকে বের করে এনে সুশাসন প্রতিষ্ঠান সহ বেশ কিছু দাবি জানিয়েছে কর্মকর্তারা।
বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যানকে পাঠানো এক চিঠিতে এমনটি দাবি করে কিছু শেয়ারধারী।
চিঠিতে বলা হয়, ইউসিবি’র পরিবারতন্ত্রের স্বেচ্ছাচার, অনিয়ম, দুর্নীতি, বিদেশে টাকা পাচার, মানি ল্যান্ডারিং ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে ব্যাংকটি ভংগুর হয়ে পড়েছে। ব্যাংকটি সুশাসন, কষ্ট অফ ডিপোজিট, ঋণের মান, আয়-ব্যয় অনুপাত, মূলধন পর্যাপ্ততা এই পাঁচটি সূচকে ইউসিবি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এথেকে অবিলম্বে উত্তরোন প্রয়োজন।
এতে আরও বলা হয়, এই ব্যাংককে পারিবারিক বলয় থেকে বের করে এনে কর্পোরেট জগতে সুপ্রতিষ্ঠ করা প্রয়োজন। একটা কর্পোরেট কালচার চালু করা একান্ত অপরিহার্য। একটা সময়ে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান রুকমিলা জামানের স্বামী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র পরিচালককে বিতাড়িত করেছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেইসব কর্মকর্তাদের আবারও পর্যদে ফিরিয়ে এনে ভারসাম্য আনা প্রয়োজন।
এটি করতে না পারলে ইউসিবি ব্যাংকের উপর অধীকাংশ শেয়ারহোল্ডার, আমানতকারী সহ সকল স্টেক হোল্ডার তাদের আস্থা হারাতে পারে। এজন্য পরিচালনা পর্ষদ পুনঃগঠন করে পরিবারতন্ত্র ভেঙ্গে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ ২৫ হাজার কোটি বা ৯ শতাংশ বেড়ে ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। তবে সিপিডির পর্যবেক্ষণে ৫.৫৬ লক্ষ কোটি টাকা অনাদায়ী। এর মধ্যে পুন:তফসিল সহ মন্দ ঋণ ২.৩২ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থ ঋণ আদালতে আটকা ১.৭৮ লক্ষ কোটি টাকা। আদলতে মামলা রয়েছে ৭২ হাজার ৫৪৩ টি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ইসলামিক ব্যাংকগুলোর আমানতে গরমিল সনাক্ত হয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা, আর বিনিয়োগে ৩২ হাজার কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে ইউসিবির খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। আদালতে আটকা ২ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা।
সারা দেশের ২.৩২ লক্ষ কোটি টাকার মধ্যে এই ব্যাংকের পুনঃ তফশিলকৃত মন্দ ঝপের পরিমাণ কত বা কত টাকার মন্দ ঋণ কার্পেটের নীচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে তা চিহ্নিত করতে বিশেষ নিরীক্ষার দাবিও করেন তারা।
দাবি করা হয়, ইউসিবিতে ব্যাপক লুটপাট করেছে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান রুকমিলা জায়। লুটপাট ও অর্থপাঁচারের ফলে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ ব্যাংকটির ৬৭ দশমিক ২৪ শতাংশ বাজার মূল্য উধাও হয়ে গেছে।
ব্যাংকের চেয়ারম্যান রুকমিলা জামান ও নেপথ্যে তার স্বামী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর অন্যায়, অবৈধ ও বে-আইনিভাবে চেয়ারম্যানের চেয়ারে বসে স্বেচ্ছাচারিতা ও লুটপাটের কারণে ব্যাংকটি আজ দেওলিয়া যাওয়ার পথে। নির্ভরযোগ্য পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ পরিবারের যুক্তরাজ্যে বা ইংল্যান্ডএ ২৬০ টি সম্পদ রয়েছে যার মূল্য ১৩৫ মিলিয়ন পাউন্ড পরিশোধ করা হয়েছে। বা ১.৮৮৮ কোটি টাকা। যা এই ব্যাংকের আমানতকারীদের টাকা লুট করে তৈরি করা হয়েছে বলেও জানান তারা।
আরেক পত্রিকা বলছেন, তার স্ত্রী, এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান রুকমিলা জামানের নামে বিদেশে ৬ টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা তিনি পরিচালনা করেন, যার মূল্য ১৬.৬৪ কোটি পাউন্ড বা ২.৩১২ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো: জেডটিজেড প্রোপাটি ভেনচার্স লিমিটেড, আরামিট প্রোপার্টিজ লিমিটেড, রুখমিলা প্রোপার্টিজ লিমিটেড, সাদাকাত প্রোপার্টিজ লিমিটেড, জেবা প্রোপার্টিজ লিমিটেড এবং জারিয়া প্রোপার্টিজ লিমিটেড। এই সবগুলো কোম্পানিরই পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি।
এর মধ্যে শুধু রুষমিলা প্রোপার্টিজ লিমিটেড এর পরিচালক পদ থেকে তিনি সরে দাঁড়িয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই কোম্পানিটির ঠিকানা লন্ডনের ওয়ারউইক লেন। বাকি সবগুলো কোম্পানির ঠিকানা লন্ডনের ডেভনশ্যয়ার স্কয়ার উল্লেখ করা হয়েছে। এই টাকা ব্যাংক থেকে লুট করা হয়েছে। খবরে আরও বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যে সম্পত্তির বিপরীতে ৫৭৩ টি মটগেজ রয়েছে। এই টাকা পাচার সংবিধানের ১৪৭(৩) ধারা লংঘন।
২০১৭ সালে ব্যাংকের কথিত পাপেট চেয়ারম্যান রুকমিলা জামান দায়িত্ব নেন। তার নেপথ্যে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তার স্বামী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। গত সাত বছরে একনাগাড়ে ব্যংকটিকে একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ও সম্পত্তিতে পরিনত করে অবাধে লুটপাট, আর্থিক দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচার করা হয়েছে।
জানা যায়, সাইফুজ্জামান চৌধুরী একজন প্রতিমন্ত্রী হয়েও ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ ও এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে ব্যাংকের বোর্ড মিটিংয়ের চেয়ারম্যানের চেয়ারে বসে সভা পরিচালনাও ও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি এখতিয়ার বহিভূত ভাবে ব্যাংকের চেয়রম্যানের আসনে বসে লাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা উপেক্ষা করে ব্যাংকের দৈনন্দিন কাজে অন্যায় ও অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করছেন। এছাড়া তিনি জোরপূর্বক তার ভাই আনিছুজ্জামান চৌধুরী রনিকে নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন।
এছাড়া একচ্ছত্র পরিবারতন্ত্র কায়েমের জন্যে তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে জোরপূর্বক অনেক স্পন্সর ডাইরেক্টরদের অন্যায়ভাবে বাদ দিয়েছেন। এমনকি এজিএম এ ডাইরেক্টর নির্বাচন হবার পরও তাদের ডাইরেক্টরশীপ নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে বাতিল করেছেন। এইভাবে পরিচালনা পর্ষদে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোনরকম নিয়মনীতি পালন না করে এক ত্রাসের পরিবারতন্ত্র কায়েম করেছিলেন বলেও দাবি করা হয়েছে।
সম্প্রতি বেসরকারি খাতের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠান নিয়ে ২০২৩ সালের সাসটেইনেবল টেকসই রেটিং প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে প্রথম ১০ টি ব্যাংকের মধ্যে ইউসিবি এর অবস্থান ৯ম। যা খুবই হতাশাজনক।
ব্যাংকটির মোট সম্পদ ৬৮.৫০১ কোটি টাকা। এর ৬৭ দশমিক ২৪ শতাংশ অর্থ ব্যাংক বাজার মূল্যে ৪৬.০৬০ কোটি টাকা মূল্য হারিয়েছে। এর থেকে বোঝা যায়, ইউসিবির হিসাবসমূহে অনেক সমস্যা ও অনিয়ম লুকিয়ে আছে বা চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। যা উন্মোচিত হওয়া প্রয়োজন। ব্যাংকের অন্তর্নিহিত শক্তি ও সম্পদের মান খুবই দূর্বল, যা চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন।
অর্থসূচ/এমএইচ



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.