বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং রাজনীতিতে বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত এক চরিত্র সালমান ফজলুর রহমান, যিনি সর্বসাধারণের কাছে সালমান এফ রহমান নামে পরিচিত। প্রবল গণআন্দোলনের মুখে সদ্য পদত্যাগকারী আওয়ামীলীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিল্প ও বেসরকারি বিনিয়োগ উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। সাবেক জাতীয় পার্টির সরকার ও আওয়ামীলীগ সরকারের এই সুবিধাভুগী প্রবল গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট সরকারের পতন হলে শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতে পালিয়ে গেছেন।
সালমান এফ রহমানকে মনে করা হয় দেশের ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারের সবচেয়ে বড় দুর্বৃত্ত। গত ১৫ বছরে ঋণের নামে ব্যাংকিং খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছেন তিনি। শেয়ারবাজার থেকেও নতুন নতুন কৌশল আর কারসাজির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। আইজিডব্লিউ, এলপি গ্যাস, সৌর বিদ্যুতের মতো নতুন নতুন খাতে প্রসারিত করেছেন তার ব্যবসা।
ধুরন্দর এই ব্যবসায়ী সবসময় সুযোগসন্ধানী। দেশের প্রধান দুই স্বৈরাচারি সরকারেরই দোসর ছিলেন তিনি। সালমান এফ রহমান ও বেক্সিমকোর মূল উত্থান জেনারেল হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে। বন্দুকের নলের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন প্রায়ত এরশাদ। দীর্ঘ নয় বছর ক্ষমতায় ছিলেন। জনগণের ম্যান্ডেটবিহীন সরকার চালাতে গিয়ে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার অসাধু লোকদের সহায়তা নেন তিনি। গড়ে তুলেন সুবিধাভুগীদের একটি চক্র। এই চক্রের অন্যতম সদস্য ছিলেন সালমান এফ রহমান। এ কারণে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় এদের বিরুদ্ধেও ক্ষোভে ফেটে পড়েন বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ।
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ মিছিল নিয়ে ধানমন্ডির দিকে রওনা হয়। উদ্দেশ্য ছিল-বেক্সিমকোর কার্যালয়ে হামলা। তবে চতুর সালমান এফ রহমান ছাত্র নেতাদের কাউকে কাউকে বিপুল অর্থের প্রলোভনে ম্যানেজ করে ওই হামলা থেকে রক্ষা পেতে সক্ষম হয়। ওই ঘটনার দুদিন পর সালমান এফ রহমানসহ এরশাদের সহযোগীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে ছাত্রদের একটি মিছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দিকে রওনা হয়। কিন্তু ফার্মগেটের কাছাকাছি মিছিলটিকে আটকে দেয় সেনাসদস্যরা। পরে ধীরে ধীরে থিতু হয়ে আসে পরিস্থিতি।
এরশাদের সঙ্গে সালমান এফ রহমানের সম্পর্ক কতটা নিবিড় ছিল সেটির প্রমান পাওযা যায়, ২০১৮ সালে। সে বছরের ২২ জানুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোতে ‘বেক্সিমকো গ্রুপকে আবারও বিশেষ সুবিধা’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট ছাপা হয়। এদিন জাতীয় সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলু বেক্সিমকোর ঋণপুনতপসিলের সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। তিনি বলেন, ব্যাংকের অর্থ লুটপাট হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন কোম্পানি হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। কিন্তু দিচ্ছে না। আদায় হচ্ছে না। বেক্সিমকোসহ কয়েকটি ঋণখেলাপি কোম্পানির নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের এসব বড় কোম্পানির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
পরদিন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ নিজ দলের সংসদ সদস্য জিয়াউদ্দিন বাবলুর বক্তব্যের প্রতিবাদ করে সংবাদপত্রে একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠান। তাতে দাবি করা হয়, ‘বেক্সিমকো নিয়ে সংসদে বাবলুর বক্তব্য নিজস্ব, দলীয় নয়: এরশাদ’। বিবৃতিতে এরপর এরশাদ বলেছেন, ‘২৩ জানুয়ারিতে সংসদে জিয়াউদ্দিন বাবলু পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে খেলাপি ঋণসংক্রান্ত বিষয়ে বলতে গিয়ে বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ পুনঃতফসিল প্রসঙ্গে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত মতামত। তাঁর এই অভিমতের সঙ্গে জাতীয় পার্টি দলগতভাবে একমত পোষণ করে না। বেক্সিমকো গ্রুপ একটি বহুমাত্রিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এর রয়েছে ৬০ হাজার কর্মী। এই গ্রুপটি বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। এই গ্রুপটি যে সকল খাতে বিনিয়োগ করেছে, সে খাতগুলো বাংলাদেশের জিডিপিতে ৭৫ শতাংশ অবদান রাখছে। জাতীয় স্বার্থেই এই ধরনের শিল্প গ্রুপের সুবিধা-অসুবিধা সকলেরই বিবেচনা করা উচিত। আমরা এটাও অনুধাবন করি যে বেক্সিমকো গ্রুপের পুনঃতফসিলীকৃত ঋণসুবিধা দেশের প্রচলিত ব্যাংকিং নীতিমালার আওতায় পড়ে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত। আমরা বিশ্বাস করি যে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান অবস্থা অর্থ মন্ত্রণালয় এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে। সুতরাং জনাব বাবলুর ব্যক্তিগত অভিমত নিয়ে এ বিষয়ে আর কোনো ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ থাকবে না।’
নিজ দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যের জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বক্তব্যকে খণ্ডন করার এই চেষ্টা থেকেই বুঝা যায়, বেক্সিমকো ও এরশাদের সম্পর্ক কতটা নিবিড় ছিল, এর পেছনে কতটা দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক ছিল।
সালমান এফ রহমান ১৯৯০-এর দশকে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তিনি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আন্দোলন নামে একটি দল গঠন করে ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিয়ে জামানত হারান। পরবর্তীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি ঢাকা-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে তৎকালীন বিএনপির প্রার্থী নাজমুল হুদার কাছে পরাজিত হন। তবে ২০১৪ থেকে পরবর্তী তিনটি নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত উন্নয়ন বিষয়ক উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হয়। তখন থেকে আওয়ামীলীগের পরবর্তী ৩ সরকারেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ওই উপদেষ্টার মূল কাজ ছিল নানা প্রলোভন অথবা ভয়-ভীতি দেখিয়ে হাসিনা সরকারের প্রতি ব্যবসায়ীদের সমর্থন আদায় করা।
দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এই উপদেষ্টার প্রভাব ছিল সরকারের যে কোনো মন্ত্রীর চেয়ে বেশি। বিভিন্ন মন্ত্রীর কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করতে যখনতখন। বিশেষ করে ২০১৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত সময়ে তিনিই মূলত অর্থমন্ত্রণালয় পরিচালনা করতেন, তখনকার অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল ছিলেন অনেকটা ডামি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নিয়োগ মূলত তার ইশারাতেই হতো। তার প্রভাবে ব্যাংকিং খাতের অনেক নীতিমালা বাংলাদেশ ব্যাংক প্রণয়ন করতে পারতো না। আবার তাদের স্বার্থের অনুকূলে যায় এমন অনেক নীতিমালা নিজেরা তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়ে দিয়েছে জাস্ট প্রজ্ঞাপন জারির জন্য। এভাবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ গ্রহণ, আবার ঋণ পুনর্গঠন ও পুনঃতফসিলের সুবিধা নিয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপ।
২০০৯ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সালমান এফ রহমান বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তাকে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান নির্বাচন করা হয়। এই ব্যাংককেও তিনি লুটপাটের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০২৩ সালে বেক্সিমকোর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট একটি ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানকে বন্ড ছেড়ে ১ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। শ্রীপুর টাউনশিপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ওই বন্ড ইস্যু করলেও আইএফআইসি ব্যাংককে বাধ্য করা হয় বন্ডটিকে ‘আইএফআইসি আমার বন্ড’ নামে প্রচারণা চালাতে। চলতি বছর আরেকটি বন্ড ইস্যু করে ২৬২৫ কোটি টাকা তুলে নেয় বেক্সিমকো গ্রুপ।
পুঁজিবাজারেও বেক্সিমকো গ্রুপের সীমাহীন লুটপাটের অভিযোগ আছে। এই বাজারে ১৯৯৬ সালে ও ২০১০ সালে যে কেলেঙ্কারি হয়েছে তার মূলহোতা মনে করা হয় সালমান এফ রহমানকে। এই দুই কেলেঙ্কারিতে দেশের লাখ লাখ মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে পথের ফকির হয়েছে। ধাক্কা সামলাতে না পেরে অনেক বিনিয়োগকারী আত্মহত্যা করেছেন। বাজারে ধসের পর সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও তাকে বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু একবারও সরকার তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে আবারও নানা কৌশলে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক হাজার কোটি টাকা। কয়েক ধাপে এই টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কারসাজির মাধ্যমে বেক্সিমকোর কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম বাড়িয়ে আগে থেকে বেনামে কিনে রাখা শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে মুনাফা যেমন আছে, তেমনই নানা নামের বন্ড ইস্যু করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনাও আছে।
দীর্ঘদিন মন্দায় থাকার পর ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে চাঙ্গা হতে থাকে দেশের পুঁজিবাজার। এ সময়ে লেনদেন পরিমাণ ও সূচক বৃদ্ধিতে বেক্সিমকো লিমিটেডকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। ওই বছরের ২০ জুলাই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল মাত্র ১৩ টাকা। এক মাসের মধ্যে এর দাম বেড়ে ২৫ টাকা হয়। এ সময় বাজারে নানা গুজব ছড়ানো হতো থাকে। অন্যদিকে হিসাবকারসাজি করে বাড়ানো হতে থাকে বেক্সিমকোর মুনাফা ও শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস)। এভাবে শেয়ারটির দাম ১৮০ টাকা পর্যন্ত ওঠানো হয়। এর পরপরই সুকুক নামের ইসলামী বন্ড ছেড়ে বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয় ৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু সুকুকের পর থেকে কোম্পানিটির মুনুফা ফের কমতে থাকে। এ অবস্থায় শেয়ারটির দর পতন ঠেকাতে ফ্লোরপ্রাইসে আটকে রাখা হয়।
২০১০ সালের আগে বিভিন্ন সময়ে বেক্মিমকো গ্রুপের একাধিক কোম্পানি ডিবেঞ্চার ছেড়ে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা উত্তোলন করেছিল। ডিবেঞ্চার ইস্যু করার কিছুদিন পর থেকেই কোম্পানিগুলো বিনিয়োগকারীদের আসল ও সুদ প্রদান বন্ধ করে দেয়। ২০২২ সালে সুকুক ইস্যুর আগে পর্যন্ত কোম্পানিগুলো খেলাপী ছিল। এছাড়া জিএমজি এয়ারলাইন্স নামে একটি কোম্পানিকে আইপিওতে আনার নাম করে উচ্চ মূল্যে প্লেসমেন্টে শেয়ার বিক্রি করে ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন সালমান এফ রহমান। এয়ারলাইন্সটি শেষ পর্যন্ত আইপিওতে আসতে পারেনি। প্লেসমেন্টে শেয়ার বিক্রির কিছুদিন পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তবু বিনিয়োগকারীদের কোনো টাকা ফেরত দেননি সালমান এফ রহমান।
এতসব ভয়ানক রেকর্ড থাকার পরও বিএসইসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের কমিশন বেক্সিমকোর সুকুক বন্ড অনুমোদন করতে দ্বিধা করেনি। তবে বিএসইসির পরামর্শে সুকুক ইস্যুর ঠিক আগে আগে বেক্সিমকো ওই ডিবেঞ্চারগুলোর অর্থ পরিশোধ করে।
ডিবেঞ্চার ইস্যুর পর থেকে বেক্সিমকোর পারফরম্যান্স আবার খারাপ হতে থাকে। কমতে থাকে এর মুনাফা ও ইপিএস। বিদিনয়োগকারীদের দেওয়া লভ্যাংশের পরিমাণ ৩০ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামে।
পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারী ও স্টেকহোল্ডাররা বেক্সিমকো ও সালমান এফ রহমানের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান, যাতে ভবিষ্যতে তিনি কিংবা অন্য কেউ বিনিয়োগকারীদের এভাবে প্রতারিত করতে না পারে।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.