সালমান ও শিবলী মুক্ত পুঁজিবাজার চান বিনিয়োগকারীরা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব তুমুল গণআন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার দুপুরে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেছেন। তার আগে-পরে পালিয়ে গেছেন অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানসহ আরও কয়েকজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপদেষ্টা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাষ্ট্র সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের পুঁজিবাজারেও সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন বিনিয়োগকারী ও বাজার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীরা। তাদের মতে, এই বাজারের সবচেয়ে বড় লুটেরা হচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) শিল্প ও বেসরকারি বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। বাজারকে চিরদিনের মতো তার প্রভাবমুক্ত না করতে পারলে ঘুরেফিরে কেলেঙ্কারি হবে, আর সর্বস্ব হারাবেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। অন্যদিকে গত পাঁচ বছরে পুঁজিবাজারে যে লুটপাট হয়েছে, তার অন্যতম সুবিধাভুগী হচ্ছেন বিএসইসির বর্তমান চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তাকে এখান থেকে সরানো না হলে কোনো সংস্কার সম্ভব হবে না। বাজারের কারসাজি বন্ধ হবে না।

অর্থসূচককে তারা বলেছেন, আওয়ামীলীগের শাসনামলে ১৯৯৬ ও ২০১০ পুঁজিবাজারে দুটি ধসের ঘটনা ঘটে। আর দুটি কেলেঙ্কারিরই মূলনায়ক ছিলেন সালমান এফ রহমান। তাতে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়েছে। কিন্তু সরকার তার কোনো বিচার করেনি। বরং আওয়ামীলীগ সরকারের সর্বশেষ মেয়াদেও  নানা কৌশলে বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, যার কারণে বাজার এখন ধুঁকছে। অন্যদিকে সালমানসহ বিভিন্ন দুষ্টচক্রকে সব রকম সহায়তা দিয়ে গেছেন বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তার প্রশ্রয় ও যোগসাজশে আবুল খায়ের হিরুসহ চিহ্নিত চক্র বাজারে একের পর এক কোম্পানির শেয়ার নিয়ে করাসাজির করে গেছে। চাপে পড়ে কাউকে কাউকে শাস্তি দিলেও তা ছিল মূলত লোক দেখানো। কেউ কারসাজি করে ১০ কোটি টাকা মুনাফা করলে তাকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

দেশের শেয়ারবাজারে ১৯৯৬ সালে প্রথম বড় কেলেঙ্কারি ঘটে। লাখ লাখ বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজি হারিয়ে পথে বসেন। ওই কেলেঙ্কারির প্রধান হোতা ছিলেন বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমান। শুধু কারসাজি করে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ানো নয়, বেক্সিমকো গ্রুপের বেক্সিমকো, শাইনপুকুর হোল্ডিংস, বেক্সিমকো ফিশারিজসহ বিভিন্ন কোম্পানির লাখ লাখ জাল শেয়ার সার্টিফিকেট বাজারে ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনেও সালমান এফ রহমানের হাত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। ধসের পর সরকার যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল, তাতেও কেলেঙ্কারির সঙ্গে সালমান এফ রহমানের সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করা হয়।

পরবর্তীতে ২০১০ সালে দেশের শেয়ারবাজারে সবচেয়ে বড় ধসের ঘটনা ঘটে। বাজারে নানা কারসাজির মাধ্যমে বাবল তৈরি করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করে উচ্চমূল্যে তাদের কাছে শেয়ার বিক্রি করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। আর এই কেলেঙ্কারির পেছনেও উঠে আসে সালমান এফ রহমানের নাম। তিনি জিএমজি এয়ারলাইন্স নামের একটি রুগ্ন কোম্পানিকে কিনে নিয়ে হিসাবকারসাজির মাধ্যমে এটিকে লাভজনক দেখিয়ে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। কোম্পানিটি শেষ পর্যন্ত বাজারে আসতে পারেনি। তবু বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দেননি সালমান এফ রহমান। কিন্তু আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা টু শব্দটিও করতে পারেননি।

তবে এখানেই শেষ নয়। পরবর্তীতে বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানিকে মার্জার ও অ্যামালগেমশনের মাধ্যমে একীভূত করার নামেও নোংরা কৌশলে তিনি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ঠকিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিন বছর সুকুক নামের ইসলামী বন্ড ছেড়ে বাজার থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছেন। অতীত রেকর্ড ভাল না থাকায় বিনিয়োগকারীরা এই বন্ড কিনতে অনাগ্রহী ছিলেন। তখন তিনি তার প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে সার্কুলার করিয়ে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে এই বন্ড কিনতে বাধ্য করেন। এই বন্ডের মাধ্যমে বাজার থেকে বিপুল টাকা বের হয়ে যাওয়ায় পুঁজিবাজারে যে তারল্য সংকট দেখা দেয়, বাজার তা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে নিয়েও বিনিয়োগকারী এবং মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীদের অভিযোগ ও ক্ষোভের শেষ নেই। তাদের মতে, গত ৫ বছরে পুঁজিবাজারে যতগুলো বড় অনিয়ম ও কারসাজি হয়েছে, তার সবই শিবলী রুবাইয়াতের প্রশ্রয়ে হয়েছে। এক যুগ আগে ইস্যু করা ডিবেঞ্চারের টাকা বিনিয়োগকারীদের ফেরত না দেওয়ার রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও শিবলী কমিশন বেক্সিমকোরকে সুকুক ইস্যু করে তিন হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। বেক্সিমকো তথা সালমান এফ রহমানের জন্য নানা আইনের প্রয়োগ শিথিল করা হয়। অভিযোগ আছে, দ্বিতীয় মেয়াদে বিএসইসির চেয়ারম্যান নিয়োগের এক সপ্তাহ আগে বেক্সিমকোর আরেকটি বন্ড অনুমোদন করে নিজের পুনর্নিয়োগ নিশ্চিত করেন শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম।

নানা দূর্বল ও জালিয়াত কোম্পানির আইপিও অনুমোদন, তালিকাচ্যুত কোম্পানির মালিকানায় নিজের লোকদের বসিয়ে সেগুলোকে মূল বোর্ডে ফিরিয়ে আনার  মাধ্যমে লুটের সুযোগ করে দেওয়া, বাজারে লাগামহীন কারসাজি, রাজনৈতিক বিবেচনায় মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স প্রদান, বিএসইসি ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জনবল নিয়োগে অনিয়মসহ নানা অপরাধের অভিযোগ রয়েছে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের বিরুদ্ধে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, খোদ বিএসইসিতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা না থাকলে পুঁজিবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। আর বিএসইসির সংস্কার নিশ্চিতের জন্যই শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে প্রতিষ্ঠানটি থেকে বিদায় করা জরুরি।

পুঁজিবাজারে সংস্কারের বিষয়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রাক্তন সচিব ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী অর্থসূচককে বলেন, গত ১৫ বছর ধরে পুঁজিবাজার পারফর্ম করতে পারছে না। কেন বাজারের এই দুর্দশা তা অবশ্যই খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এখানে কমিশনের কোনো ব্যর্থতা আছে কিনা, বিধিবিধানের কোনো পরিবর্তন দরকার কিনা- সেগুলোও খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে বিএসইসির উপর বিনিয়োগকারীদের ন্যুনতম আস্থা নেই। আস্থা ফিরিয়ে আনতে যা যা দরকার, তার সবই করতে হবে। তবে বর্তমানে কিছুটা অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে সব। এ সময়ে সংস্কার করলে ভাল ফল নাও আসতে পারে। তাই একটু স্থিতিশীলতার জন্য অপেক্ষা করা ভাল মনে হয়।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ অর্থসূচককে বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্যে দেশের পুঁজিবাজারসহ সবকিছু পড়ে। এর আগে বাজারে সব দুই নাম্বারি ও ভোগাজ শেয়ার আনা হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে ভালো শেয়ার কিভাবে আনা যায় সেটা দেখতে হবে। এছাড়া অধিকাংশ উদ্যোক্তা শেয়ারের দাম বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এসব ক্ষেত্রে রেগুলেটরও চুপ থাকে।

তিনি আরও বলেন, দেশের পুরো অর্থনীতি মাফিয়াদের হাতে। পুঁজিবাজারেও মাফিয়া ও দুষ্টরা আছে। মাফিয়ারা রেগুলটরের অনুমতি নিয়েই শেয়ার কারসাজি করে। এসব কাজে রেগুলেটর পুরোপুরি সায় দেয়। নতুন সরকার এগুলো নিশ্চয়ই দেখবে। কারণ পুঁজিবাজারকে ভালো করতে হবে। আর এজন্য বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো দরকার।

অর্থসূচক/

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.