কাস্টমসের মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে বিশাল দুর্নীতির অভিযোগ আর তার পরিবারের বিলাসী জীবনযাপনের ইস্যুটি এখনো চাপা না পড়ায় মতিউর-ঘনিষ্টদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে মতিউরের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের হজ্জ পালনের একটি ছবি প্রকাশের পর এ উদ্বেগ আরও বেড়েছে। এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মতিউরের সঙ্গে আরও কিছু ‘বিশিষ্ট ব্যক্তি’র ছবি প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশে সাধারণত প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ইস্যু তৈরি হয়। ফলে গণমাধ্যমে একটি ইস্যু বেশিদিন ফোকাসে থাকে না। এ কারণে মতিউর ও তার দুর্নীতির সুবিধাভোগীদের ধারণা ছিল সপ্তাহখানেকের মধ্যে এই ইস্যুটিও চাপা পড়বে। কিন্তু তাতো হয়-ই নি, বরং গণমাধ্যমে এখনো নিয়মিত রিপোর্ট হচ্ছে, আর তাতে ওঠে আসছে নতুন নতুন তথ্য। এ কারণে আগামীতে মতিউরের দুর্নীতি বলয়ের সঙ্গে যুক্ত অথবা অনেক সুবিধাভোগীর ছবি ও তথ্য প্রকাশের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তাতে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে তাদের।
এদিকে গণমাধ্যমের ধারাবাহিক রিপোর্টের কারণে মতিউর ও তার পরিবারের সাম্রাজ্য লণ্ডভণ্ড হওয়ার পথে। এতদিন নানা কৌশলে আড়াল করে রাখা জমি, ফ্ল্যাট, রিসোর্ট, ইন্ডাস্ট্রি, বিলাসী গাড়ি, কানাডার বাড়ি, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ইত্যাদি সব তথ্য প্রকাশ্যে চলে এসেছে। বেনামে করা সম্পদের তথ্যও আড়াল করে রাখা যায়নি। একজন সাবেক শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও মতিউরের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকী কী করে প্রায় শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন, মতিউরের বেকার ও গার্মেন্টস শ্রমিক দুই ভাই কীভাবে একাধিক ইন্ডাস্ট্রির মালিক বনে গেছেন-সেসব প্রশ্ন এবং তার উত্তরও গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে। মতিউরের অবৈধ অর্থে-ই যে এসব হয়েছে তা এখন জলের মত পরিস্কার। তাতে গণমাধ্যমের উপর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত মতিউর ও তার প্রথম স্ত্রী লাকী। এই ক্ষোভের বহি:প্রকাশ ঘটেছে রায়পুরা উপজেলার চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ লাকীর সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে।
গত বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) রায়পুরা উপজেলা পর্ষদের কার্যালয় থেকে বের হওয়ার সময় ঔদ্ধত্যের সঙ্গে লাকী বলেন, ঢাকা ও নরসিংদীর জাতীয় পত্রিকা ও টিভির বড় বড় সাংবাদিকদের কিনেই উপজেলা পরিষদে এসেছি। তারা আর কিছু করতে পারবে না। সব থেমে যাবে। পাছে লোকে কত কিছুই বলে। তাতে আমার কিছু আসে যায় না।
সাংবাদিকদের সম্পর্কে ঢালাও এমন অভিযোগের মাধ্যমে তাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি ফোকাসটা অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। সাংবাদিকদের চরিত্রহনন করা গেলে তাদের রিপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে-এমন দুরাশা থেকে থাকতে পারে তার ওই বক্তব্যের পেছনে। তবে এ চেষ্টা শেষ পর্যন্ত আত্মঘাতী হবে বলেই মনে হয়। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করার কারণে তারা মতিউর ও তার পরিবারের দুর্নীতির অনুসন্ধানে আরও উদ্যমী হয়ে ওঠতে পারেন। তাতে বৃহত্তর ক্যানভাসে ওঠে আসতে পারে মতিউরের দুর্নীতিবলয়ের চিত্র।
মতিউরের দুর্নীতি ও বিপুল অর্থ উপার্জন নিয়ে এখন পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্টে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তাব্যক্তি, অসাধু আমলা ও রাজনীতিবিদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে তিনি এতটা বেপরোয়া হয়ে ওঠেছিলেন। সম্প্রতি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ‘তিন প্রভাবশালীর প্রশ্রয়ে এত বেপরোয়া মতিউর’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে বেশ কিছু ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, তিন প্রভাবশালীর প্রশ্রয়ে তিনি এই বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। মতিউরকে প্রশ্রয় দেওয়া তিন প্রভাবশালীর এক জন ক্ষমতাধর সচিব। এক জন প্রশাসন ক্যাডারের অত্যন্ত প্রভাবশালী কর্মকর্তা। আরেক জন বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম শীর্ষ পদে আছেন। তার বদৌলতেই মতিউর সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হন। অন্য প্রভাবশালী হলেন এক্সচেঞ্জের অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা। যিনি শিক্ষকতা থেকে এখানে এসেছেন। তার কাছ থেকেই বিশেষ সুবিধা পেয়ে মতিউর প্লেসমেন্ট শেয়ারের কারসাজি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
জানা গেছে, মতিউর রহমান শেয়ারবাজার থেকে যে কৌশলে বিপুল অর্থ কামিয়েছেন, তা অনেকটা আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। অনেক ক্ষেত্রে আইনের ফাঁকফোঁকর ব্যবহার করেছেন। কিছু কিছু বিষয় ছিল স্রেফ কারসাজি। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার বর্তমান ও সাবেক কর্তা ব্যক্তিদের কারো কারো প্রশ্রয়ে ও যোগসাজশে সেটি সম্ভব হয়েছে। নিজের পথ পরিস্কার রাখতে বিভিন্ন সেক্টরের বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিকেও তিনি সুবিধা দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও অনেক রাজনীতিবিদ, আমলা, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যসহ সমাজের নানা পর্যায়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে মতিউরের কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন। এসব সুবিধাভোগী এখন আতঙ্কে আছেন। বিশেষ করে দৈনিক ইত্তেফাকে তিন প্রভাবশালীর প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশের দু’দিনের মাথায় মতিউরের সঙ্গে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের ওমরাহ পালনের সেলফি প্রকাশের পর এ আতঙ্ক অনেক বেড়ে গেছে। অনেকেই ভয়ে আছেন, যে কোনো মুহূর্তে যে কারো মুখোশ খুলে যেতে পারে।
তাদের কারো কারো আতঙ্কের কারণ হচ্ছে, কার্যকর ও বিশদ তদন্ত হলে মতিউরের দুষ্কর্মের সহযোগী ও সুবিধাভোগীদের বিষয়টিও ওঠে আসবে। তাতে কেউ কেউ আইনী সমস্যায় পড়তে পারেন। আবার আইনী সমস্যায় না পড়লেও মতিউরের সঙ্গে ঘনিষ্টতার কোনো ছবি বা সুবিধা নেওয়ার তথ্য প্রকাশ পেলে সামাজিকভাবে প্রচণ্ড হেয় হতে হবে বলে তাদের আশংকা। মতিউরের মত এতবড় দুর্নীতিবাজ মানুষের সঙ্গে মাখামাখি বা সুবিধা নেওয়ার বিষয়টি সামনে চলে এলে তাদের ভাবমূর্তি দারুণভাবে নষ্ট হবে। এগুলো কারো কারো ক্যারিয়ারে কাঁটা হয়ে দেখা দিতে পারে।
প্রসঙ্গত, ঈদ-উল-আজহার আগে সাদিক অ্যাগ্রো থেকে মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রীর পুত্র মুশফিকুর রহমান ইফাত ১২ লাখ টাকায় একটি ছাগল কেনার বায়না করে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। এছাড়া তিনি ঢাকার বিভিন্ন খামার থেকে ৭০ লাখ টাকায় গরু কেনেন বলে খবর প্রকাশ হয়। ছাগলকাণ্ডে ব্যাপক সমালোচনার মুখে গণমাধ্যমের কাছে মতিউর ইফাতের পরিচয় অস্বীকার করেন, এমনকি এই নামে কাউকে চেনেন না বলেও দাবি করেন। তাতে গণমাধ্যমের আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। একের পর এক প্রতিবেদনে ওঠে আসতে থাকে তার নামে-বেনামে থাকা বিপুল সম্পদের তথ্য। বিষয়টি সরকারের জন্য বিব্রতকর হয়ে পড়লে তাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এক্সসাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে অর্থমন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীন সম্পদ বিভাগে যুক্ত করা হয়। অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। দুদকের অনুরোধে মতিউর ও তার পরিবারের সদস্যদের সব ব্যাংক হিসাব ও শেয়ারবাজারের বিও হিসাব জব্দ করা হয়। দুদকের আবদেনের প্রেক্ষিতে আদালত মতিউর রহমান, তার প্রথম পক্ষের স্ত্রী কানিজ ফাতেমা লাকী ও তার ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.