আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যে উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়েছে তা যথেষ্ট নয়। সঠিক সময়ে যদি যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া না হয় তাহলে ২০২৫ সাল শেষে দেশের অর্থনীতি উন্নতির বদলে আরও খারাপ হতে পারে বলে জানিয়েছেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান।
শনিবার (৮ জুন) রাজধানীর মহাখালী ব্র্যাক সেন্টার ইনে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম আয়োজিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনায় এমন মন্তব্য করেন তিনি।
ড. সেলিম রায়হান বলেন, অর্থনীতিতে এক বছর আগের তুলনায় উদ্বেগের মাত্রা এখন আরও বেড়েছে। যদি আমরা সামষ্টিক অর্থনীতির ফান্ডামেন্টালগুলো ঠিক করতে না পারি তাহলে কী অর্থনীতি আরেক বছর পর আরও খারাপ হবে। এখনই যদি মৌলিক দিকগুলো নিয়ে কাজ না করা হয় তাহলে সামনের দিনগুলোতে অর্থনীতিতে চ্যালেজ্ঞ বাড়বে।
বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, এই সুযোগ রাখলে অনেকে কালো টাকা রাখার জন্য উৎসাহিত হবেন। কারণ পরবর্তীতে এ অর্থ সাদা করে ফেলতে পারবেন। তবে যারা কালো টাকা রাখবেন তারা সাদা করার জন্য বেশি আগ্রহী হবেন না।
করের বিষয়ে সেলিম রায়হান বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষ ও মধ্যবিত্তদের উপর করের চাপ বেশি পড়বে। যেসব পণ্য ও সেবার কর বাড়ানো হয়েছে তা লাক্সারি পণ্য নয়। সেগুলো এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ। মোবাইল ফোন ও সিমও এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় একটি সেবা। এসব পণ্যের কর বৃদ্ধি করার ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের উপর চাপ বেশি পড়বে। আর উচ্চবিত্তের উপর এগুলো তেমন প্রভাব পড়বে না। ধনীদের অনেক ইনকাম করের আওতায় নেই এবং নানা কারণে তারা করের আওতার বাইরে। তাদেরকে যদি এর আওতায় আনা না যায় তাহলে তাদের উপর করে বোঝা পড়বে না।
বাজেট বাস্তাবায়নের বিষয় তিনি বলেন, দেশের প্রতিবছর বাজেটের ৮০ শতাংশ খরচ করা সম্ভব হয়। অনেক খাতের বরাদ্দ খরচ করতে না পেরে সরকারকে আবার ফেরত দেওয়া হয়। গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো কতটুকু বাস্তবায়ন করা হলো সেটিই হওয়া উচিত বাজেট বাস্তবায়ন। পূর্বের বাজেটে দেখা গেছে সব টাকা খরচ হয়না এবং প্রকল্পও বাস্তবায়ন হয় না। আগামী অর্থবছরেও যদি বাজেটের ৮০ শতাংশ খরচ হয় তাহলে অর্থনীতি আরও খারাপ হবে।
কমতে থাকা রিজার্ভ নিয়ে সানেমের নির্বাহী পরিচালক বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক কিছু নেই। বাজেটে বলা হয়েছে, আগামী অর্থবছর শেষে রিজার্ভ বেড়ে ৩২ ডলার হবে। তবে এটা কিভাবে সম্ভব হবে তা কিন্ত উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ বাজেটে এরকম অনেক কিছুই প্রাক্কলন করা হয়েছে যা বাস্তবসম্মত না।
এদিকে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হয়ে যাবে। এর ফলে বাংলদেশের অর্থনীতিতে তখন নতুন করে আরেকটি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হবে। এই চ্যালেজ্ঞ মোকাবিলার জন্য রপ্তানিখাতকে প্রস্তত করে তোলা ও রপ্তানি বহুমুখীকরণের অতীতের চেষ্টা সফল হয়নি। আগামী দুই বছরের মধ্যে এসব খাতের সফল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। অর্থাৎ ২০২৬ সালের নভেম্বরে এলডিসি থেকে বের হওয়া মাত্রই অর্থনীতিতে নতুন একটি চাপ তৈরি হবে। সুতরাং সামনের কয়েকটি বছর অর্থনীতিতে চাপের বছর। এসব চাপ থেকে উত্তরণ পাওয়ার জন্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের উদ্যোগগুলো যথেষ্ট নয় বলেও মন্তব্য করেছেন সেলিম রায়হান।
অর্থনীতির এই সংকটের সময়ে কি ধরনের সংস্কার নেওয়া উচিত এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের একটি সুবর্ণ সুযোগ গেছে। তখন প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার ও মূল্যস্ফীতি একটি সন্তোষজনক যায়গায় ছিলো। তখনও আমরা ব্যাংক ও কর খাতের সমস্যা নিয়ে কথা বলেছি। যেহেতু অর্থনীতি ভালোভাবে চলছিলো তাই সংস্কারের বিষয়গুলো ধামাচাপা ছিলো। অর্থনীতি কোভিডে ধাক্কা খেলো এবং এরপর ধারাবাহিকভাবে আরও ধাক্কা আসলো, যা অর্থনীতি নিতে পারেনি। কারণ অর্থনীতির ভীত মজবুত ছিলো না। এ খাতের দির্ঘদিন সংস্কার না করার ফলে অর্থনীতি লাইনচ্যুত হয়েছে। আমাদের যদি শক্তিশালী কর কাঠামো, শক্তিশালী আর্থিক খাত ও রপ্তানি বহুমুখীকরণ হতো তাহলে এই ধাক্কা সামাল দেওয়া সম্ভব হতো।
সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়েমা হক বিদিশা বলেন, যারা সৎভাবে ব্যবসা করে বড় ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলবে এবং কর্মসংস্থান তৈরি করবে তাদেরকেই প্রণোদনা দেওয়া দরকার। তবে যদি এভাবে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয় তাহলে সৎ ব্যবসায়ীরা ভীষণভাবে নিরুৎসাহিত হবেন। এর ফলে দেশে ভালোভাবে ব্যবসা করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং দেশে টাকার রাখার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তখন টাকা পাঁচার করার প্রবণতা আরও বেড়ে যাবে।
তিনি বলেন, গত এক বছর ধরে মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে, যা বর্তমানে ৯ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করছে। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি কমানোর সঠিক কোনো কর্মপরিকল্পনা বাজেটে নেই। খেলাপি ঋণ কমানোর জন্যও কোনো কর্মপরিকল্পনা বাজেটে নেই। প্রতিবছর ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া উচিত না। এতে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে।
বিদিশা আরও বলেন, খোলাবাজারের সঙ্গে অফিসিয়ালি ডলারের দামে যতদিন পার্থক্য থাকবে ততদিন হুন্ডি চলতে থাকবে। এজন্য এই দুই যায়গায় ডলারের দর কাছাকাছি করা উচিত। পাশাপাশি হুন্ডি ও কালো টাকার দিকে কঠোর নজর দেওয়া দরকার।
এদিকে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এবার বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ কমছে। চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি কম ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অনুদান ছাড়া বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। তবে, অনুদানসহ সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়াবে দুই লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগামী অর্থবছর চার হাজার ৪০০ কোটি টাকা অনুদান পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বৈদেশি ঋণ পরিশোধ করা হবে ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এতে নিট বৈদেশিক ঋণ দাঁড়াবে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে এক লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যার ৭২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ এবং ৬৪ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা স্বল্পমেয়াদি। ব্যাংক-বহির্ভূত ঋণ নেওয়া হবে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
অর্থসূচক/এমএইচ/এএইচআর
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.