নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার পেছনে কৃষকরাও দায়ী বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। তিনি বলেন, এবারের বাজেটে এমন কিছু রাখা হয়নি যাতে করে বাজার অস্থির হবে। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার পেছনে কৃষকরাও দায়ী। আপনারা জানেন, দেশে ধানের উৎপাদন বাড়লে কৃষকরা ধান বিক্রি করে তেল কিনে, সবজি কিনে। সবজি আর তেল কেনার জন্য দেখা গেল ধান বেশি করে বিক্রি করছেন। এতে করে চালের দাম বৃদ্ধি পেয়ে যাচ্ছে।
শুক্রবার (৭ জুন) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী এ কথা বলেন।
আহসানুল ইসলাম বলেন, রমজানের পর থেকে এখনো তেল-চিনির দাম ভারসাম্য অবস্থায় আছে। ধান-চাল আমদানিতে কর দুই-এক শতাংশ করা হয়েছে বাজেটে। এখন এক কোটি নাগরিক ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য পাচ্ছেন। আসন্ন বাজেটের মেয়াদে ন্যায্যমূল্যে পণ্য দিতে স্থায়ী দোকানের মাধ্যমে টিসিবির পণ্য দেওয়ার কাজ চলছে। এটা হলে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ এর মাধ্যমে উপকৃত হবেন। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, আপনারা জানেন আমাদের ভোক্তা অধিকার রয়েছে। সেটির মাধ্যমে আমরা বাজার মনিটরিংগুলো করি। ঈদকে সামনে রেখে সেটি আমরা অব্যাহত রেখেছি। বাজেটে কর মওকুফ করায় আমাদের নিত্যপণ্যের দাম কমবে। আমাদের বাজার নিয়ন্ত্রণের সাথে দেশের বিভিন্ন ঋতুতে আবহাওয়ার বিপর্যয় ঘটে। এতে করে আমরা যখন দেখতে পাই নিত্যপণ্যর দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন ট্যাক্স কমিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবো। এবারের বাজেটে ১৭২টি পণ্যের ওপর শুল্ককর কমানো হয়েছে। আমাদের বিভিন্ন ঋতুতে সংকট ও বিপর্যয় হয়।
সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ছাড়াও উপস্থিত আছেন পরিকল্পনামন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী, অর্থ প্রতিমন্ত্রী, অর্থ সচিবসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।
গতকাল (৬ জুন) দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়। এদিন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে এই বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
প্রস্তাবিত বাজেটে শুল্ক ও কর বৃদ্ধির কারণে বাড়তে যেসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে- এমিউজমেন্ট ও থিম পার্ক, ফ্রিজ ও এসি, আইসক্রিম ও কোমল পানীয়, এলইডি ও এনার্জি সেভিংস লাইট, সিগারেট ও বিড়ি, আমসত্ত্ব ও জুসের দাম, মোবাইল কলরেট, সিম ও ইন্টারনেট, ইট, সিসি ক্যামেরা, মোটর সাইকেল, লাইট হোল্ডার, ফল, বিদেশি কাজুবাদাম, ম্যাকারেল মাছ, ফুল, এলপিজি সিলিন্ডার, সুইচ, সকেট, আয়রন, জেনারেটর ও ওয়াটার ফিল্টার।
যেসব পণ্যের দাম কমতে পারে – ডায়ালাইসিস ফিল্টার ও সার্কিট, ডেঙ্গু কিট, গুঁড়া দুধ, চকলেট, বিদেশি পোশাক, এয়ারক্রাফট ইঞ্জিন, ইলেকট্রিক মোটর, এয়ারক্রাফট প্রপেলার, মিথানল, স্পাইনাল নিডল, মাশরুম ও শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল ম্যাঙ্গানিজ।
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এবার বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ কমছে। চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি কম ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অনুদান ছাড়া বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। তবে, অনুদানসহ সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়াবে দুই লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগামী অর্থবছর চার হাজার ৪০০ কোটি টাকা অনুদান পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বৈদেশি ঋণ পরিশোধ করা হবে ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এতে নিট বৈদেশিক ঋণ দাঁড়াবে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে এক লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া হবে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যার ৭২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ এবং ৬৪ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা স্বল্পমেয়াদি। ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেওয়া হবে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধের ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের সুদ ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর বহির্ভূত কর ধরা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। করব্যতীত প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।
এ ছাড়া বাজেটের আয়-ব্যয়ের বিশাল ঘাটতি পূরণে প্রধান ভরসাস্থল হিসেবে ব্যাংক খাত বেছে নিয়েছে সরকার। ঘাটতি পূরণে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেবে বলে লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। এই অংক চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পাঁচ হাজার ১০৫ কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছিল সরকার। তবে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রায় এটি বাড়িয়ে এক লাখ ৫৫ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা ঠিক করা হয়েছে।
আগামী ৩০ জুন প্রস্তাবিত বাজেট পাশ হবে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশের ৫৩তম বাজেট এটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা চতুর্থ মেয়াদের শেষ বাজেট এটি। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর এটি প্রথম বাজেট। স্বাধীনতা-পরবর্তী ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশে মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট দেন তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৭২ সালের ৩০ জুন ওই বাজেট পেশ হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ওই দিন একই সঙ্গে ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর, অর্থাৎ দুই অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছিলেন। এরপর আরও দুবার বাজেট দেন তাজউদ্দীন আহমদ, সেটি সবশেষ দাঁড়ায় ১ হাজার ৮৪ কোটি টাকার। ১৩ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার বাজেট দিয়েছেন সদস্য প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও এম সাইফুর রহমান। দুজনেই ১২টি বাজেট উত্থাপন করেছেন। তবে আবুল মাল আবদুল মুহিতই আওয়ামী লীগের হয়ে টানা ১০ বার বাজেট পেশ করেছেন। তিনি প্রথম বাজেট দেন ১৯৮২-৮৩ সালে, এরশাদের শাসনামলে। সেটার আকার ছিল ৪ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা।
অর্থসূচক/এমএইচ/এএইচআর



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.