বাজেট ঘাটতি যেভাবে পূরণ হয়

প্রথম দিন থেকেই বাংলাদেশ ঘাটতি বাজেট করে আসছে। এর ফলে ধার করে সরকারকে বাজেটের ঘাটতি পূরণ করতে হয়। বৈদেশিক উৎস এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এসব অর্থ ধার করা হয়। বৈদেশিক উৎসের মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক ঋণ, আর ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থা থেকে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস হিসাবে ঋণ নেয়।

বৈদেশিক উৎস মূলত বৈদেশিক ঋণ। সরকার বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশ থেকে সহজ শর্তে ঋণ নেয়। বৈদেশিক উৎস থেকে বেশি ঋণ নিয়ে ঘাটতি পূরণ করতে পারলে তা অর্থনীতির জন্য বেশি সহনীয়। কারণ, এতে সুদহার কম এবং পরিশোধে অনেক সময় পাওয়া যায়। যদিও এ জন্য নানা ধরনের শর্ত পূরণ করতে হয়। যেমন এখন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচির মধ্যে আছে। এ জন্য অনেক শর্তও পূরণ করতে হচ্ছে।

অন্যদিকে সরকার দুই ভাবে দেশের ভেতর থেকে ঋণ নেয়। যেমন ব্যাংকিং–ব্যবস্থা ও ব্যাংকবহির্ভূত–ব্যবস্থা। ব্যাংকবহির্ভূত–ব্যবস্থা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। এভাবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ঋণ নেয় সরকার। তবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার দুটি বিপদ আছে। ব্যাংকিং–ব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের জন্য অর্থ থাকবে কম। ফলে বিনিয়োগ কমে যায়। আর ব্যাংকবহির্ভূত–ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিলে বেশি হারে সুদ দিতে হয়। এতে সুদ পরিশোধে সরকারকে বেশি পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ রাখতে হয়। এতে পরের অর্থবছরের বাজেট বেড়ে যায়।

ব্যক্তি যা পারেন না, সরকার কিন্তু তা করতে পারে। সরকার টাকা ছাপিয়ে বাজেট–ঘাটতি পূরণ করতে পারে। তবে এই পথে বাজেট–ঘাটতি পূরণ করার বিপদও আছে। এতে মুদ্রা–সরবরাহ বেড়ে যায় এবং মূল্যস্ফীতি তৈরি। এখন যে বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, এর অন্যতম কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক এক বছর আগে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দিয়েছে।

ঘাটতি বেশি থাকাটা আবার ভালো নয়। সাধারণত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ পর্যন্ত ঘাটতিকে মেনে নেওয়া হয়।

সাধারণত উন্নত দেশগুলো সুষম বাজেট করে থাকে। তবে প্রতিবছরই সুষম বাজেট করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। উন্নত বা ধনী দেশগুলো বাণিজ্য চক্র মেনে সুষম বাজেট করে। অর্থাৎ অর্থনীতির ওঠা–নামার সঙ্গে সমন্বয় করে একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরের বাজেট তৈরি করা হয়। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো হলে সুষম বাজেট, খারাপ হলে ঘাটতি বাজেট। অনেক উন্নত দেশই আইন করে সুষম বাজেট তৈরি করে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, অব্যাহতভাবে সুষম বাজেট তৈরি করা ভালো কিছু নয়; বরং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই বাজেট কেমন হবে তা ঠিক করা উচিত। কেননা, সুষম বাজেট সুদের হার কমায়, বাড়ায় সঞ্চয় ও বিনিয়োগ। এ ছাড়া বাণিজ্যঘাটতি কমিয়ে আনে। এতে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতি এগিয়ে যায়।

সাধারণত অর্থনীতি ভালো অবস্থায় থাকলে সুষম বাজেট করা হয়, খারাপ হলে অর্থনীতিকে উদ্দীপনা দিতে তৈরি হয় ঘাটতি বাজেট। একটা সময় ছিল যখন ঘাটতি বাজেটকে ক্ষতিকর ও সরকারের দুর্বলতাও ভাবা হতো। পরিস্থিতি এখন পাল্টেছে; বরং অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে কিছুটা ঘাটতি থাকা ভালো। এতে অব্যবহৃত সম্পদের ব্যবহার বাড়ে, ঘাটতি পূরণের চাপ থাকে। তাতে অর্থনীতিতে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। ঘাটতি বেশি থাকাটা আবার ভালো নয়। সাধারণত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ পর্যন্ত ঘাটতিকে মেনে নেওয়া হয়।

যদিও ক্ল্যাসিক্যাল বা ধ্রুপদি অর্থশাস্ত্রীরা ঘাটতি বাজেট অনুমোদন করতেন না। তবে জাতীয় আয় বৃদ্ধি করার একটি কৌশল হিসেবে ঘাটতি বাজেটের মাধ্যমে সম্পদ সংস্থানের ব্যবস্থাকে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনসই প্রথম অনুমোদন করেন। তাঁর মতে অর্থব্যবস্থায় অপূর্ণ নিয়োগের সমস্যা দূর করতে হলে এবং মন্দাভাব এড়াতে হলে বাজেটে সমস্থিতি বজায় রাখলে কোনো কাজ হবে না। এর জন্য চাই ঘাটতি বাজেটের মাধ্যমে অতিরিক্ত ব্যয় বরাদ্দ করে নতুন আয় সৃষ্টি। এতে জাতীয় আয় বাড়ে এবং অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।

প্রথম বাজেটটি দিয়েছিল মুজিবনগর সরকার। স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য দরকারি, অপরিহার্য ব্যয় মেটাতেই এই বাজেট। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ের জন্য তৈরি হয়েছিল এই বাজেট। এ বাজেটের আকার ছিলো ৮ কোটি ৬২ লাখ ৪৮ হাজার ২০৪ টাকা। এরই মধ্যে পার হয়ে গেছে ৫৪টি বাজেট। এবারের ৫৪তম বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা।

আজ বৃহস্পতিবার (৬ জুন) জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন ৮২ বছর বয়সী অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এটি তার প্রথম বাজেট।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নতুন অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব করা হচ্ছে, তাতে ঘাটতিই থাকবে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এই বিশাল পরিমাণ ঘাটতি পূরণে কয়েকটি খাতকে উৎস হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে ব্যাংকিং খাত। এই খাত থেকে মোটা দাগে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হচ্ছে।

এর বাইরে বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য বিদেশ থেকে এক লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার সহায়তা পাওয়া যাবে বলেও ধরা হয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ কোটি টাকার প্রকল্প ঋণও রয়েছে। এর পাশাপাশি ব্যাংক বহির্ভূত খাত হিসেবে বিবেচিত সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া হবে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। জানা গেছে, নতুন অর্থবছরে মোট রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে যা ছিল ৫ লাখ কোটি টাকা। রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮ শতাংশ।

নতুন রাজস্ব প্রাপ্তির মধ্যে বরাবরের মতো এবারও বেশির ভাগ আয় করার দায়িত্বটি থাকবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে এনবিআরকে রাজস্ব আয়ের টার্গেট দেয়া হয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। নন-এনবিআর থেকে আসবে আরো ১৫ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত প্রাপ্তির টার্গেট থাকছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।

এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে চার শতাংশের একটু বেশি। মূলত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দিকে নজর দিতে গিয়ে বাজেটের আকার বাড়াতে পারেনি সরকার।

অর্থসূচক/এমএইচ

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.