বিদ্যুৎ খাতে সঠিক পরিকল্পনা জরুরি: শাহেদ সিদ্দিকী

শাহেদ সিদ্দিকী একজন তুখোড় সাংবাদিক। দীর্ঘদিন মাঠ পর্যায়ে রিপোর্টিং করেছেন। জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাত নিয়ে করেছেন অসংখ্য অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। এই খাতে তার রয়েছে অগাধ জ্ঞান। তিনি বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও টেলিভিশন টক শোতে রিসোর্স পারসন হিসেবে অংশ নিয়ে থাকেন। বর্তমানে তিনি বেসরকারি টেলিভিশন ইনডিপেনডেন্ট টিভির হেড অব আউটপুট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি অর্থসূচককে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি দেশে চলমান জ্বালানি-বিদ্যুত পরিস্থিতির নানা দিক নিয়ে আলোকপাত করেছেন। 

অর্থসূচকঃ আপনিতো প্রায় ২২ বছর ধরে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি খাত নিয়ে কাজ করছেন। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি খাত নিয়ে সংকট কাটছে না কেন?

উত্তর: যে কোন দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি সেক্টর হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জ্বালানি খাতের উন্নয়ন বা নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ ছাড়া দেশের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশে এ খাতে একটা বড় ধাক্কা খাচ্ছে। কারণ অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং এর ব্যয় মেটাতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে, জ্বালানি খাত বিশেষ করে গ্যাস খাতে গত ২০ বছর ধরে তেমন কোন বড় ধরনের উন্নয়ন হয় নি। বলা যায়, আমাদের ভূমি ( অন শোর ) এবং বঙ্গোপসাগরে ( অফ শো) এ বড় কোন অনুসন্ধান হয় নি। যার ফলাফল হচ্ছে বাংলাদেশকে একটি বড় ধরনের সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে।  অন্যদিকে গ্যাস খাত অনেকটা আমদানির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আমদানি কম হলে দেশে তীব্র সংকট হচ্ছে। দেশের শিল্প কারখানা স্থবির হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ একটা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে।

অর্থসূচকঃ সরকারতো বিদ্যুৎ খাত নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট। দেশের প্রায় শত ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে । উৎপাদন ক্ষমতাও আছে । তাহলে লোডশেডিং হচ্ছে কেন?

শাহেদ সিদ্দিকীঃ সবাইকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে। এটা ইতিবাচক। কিন্তু হয়েছে কি ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়া হয়েছে। পরিকল্পনায় বেশ গলদ আছে বলে মনে করি। যেমন এখন দেশে প্রায় ১৫০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে। যার উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। কিন্তু আমরা কত উৎপাদন করি। সবোর্চ্চ উৎপাদনের রেকর্ড হচ্ছে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। অনেক জায়গায় আমাদের বিতরণ লাইনের সমস্যা আছে।বিশেষ করে ৩৩ কেভি এবং ১১ কেভিতে। আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে । পাওয়ার প্ল্যান্ট বা বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে। কিন্তু এর জন্য ফুয়েল কেনার পয়সা নেই। যেমন প্রতিটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ৬ থেকে ৭ মাসের বিল বকেয়া পরে আছে। তারা বিল না পেলে ফুয়েল কিনবে কিভাবে। এনার্জি বিল টা আলাদা করে দেয়ার কথা। কিন্তু সেটাও সরকার দিতে পারছে না। কেন দিতে পারছে না, সেটা সবার জানা। বিশেষ করে ডলার সংকট। আর বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রির কারনে এ পরিস্থিতি হয়েছে।

অর্থসূচকঃ এখন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কি।

শাহেদ সিদ্দিকীঃ কথা একটাই। বিদ্যুৎ খাতে ঠিক মত পরিকল্পনা করতে হবে। জাপানের অর্থায়নে পাওয়ার সেক্টর মাস্টার প্ল্যান করা হয়েছে। কিন্তু তা কতটুকু মানা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে আমরা দেখছি কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়া শুধু বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট বেসরকারি খাতে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেই প্ল্যান্ট কতটুকু কাজে লাগবে বা তার ফুয়েল কোত্থেকে আসবে তা চিন্তা করা হয়নি। এমন পরিস্থিতি চিন্তার কারন হয়ে দাড়াচ্ছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত বন্ধ করে দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা নিতে হবে। এ ছাড়া কয়লা, ফানের্স, গ্যাস, রিনিউয়েবল এবং জল বিদ্যুৎ থেকে আগামীতে কত বিদ্যুৎ আসবে তা দেখা দরকার। পরিকল্পনা করা দরকার ১০ বছর থেকে শুরু করে ৫০ বছর পর্যন্ত। এ ছাড়া হুট হাট করে কাউকে পাওয়ার প্ল্যান্ট বসানোর অনুমতি দেয়া যাবে না। একটা মাস্টার প্ল্যান করে উচ্চমূল্যের প্ল্যান্টগুলো বন্ধ করা দরকার। রিনিউয়েবল এবং জলবিদ্যুৎকে অগ্রাধিকার দেয়া দরকার। নতুবা এ জাতিকে অনেক মাসুল দিতে হবে। এখানে একটি তথ্য দেই গত ১০ বছরে সরকার শুরু ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে সেরা রিপোর্টারের পুরস্কার নিচ্ছেন শাহেদ সিদ্দিকী

অর্থসূচকঃ গ্যাস খাতের ভবিষ্যৎ কি

শাহেদ সিদ্দিকীঃ দু:খজনক হলেও সত্য জ্বালানি খাতের অবস্থা বিদ্যুৎ খাতের চেয়ে খারাপ। পেট্রোবাংলার হিসেব অনুযায়ী দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪৫০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু সরবরাহ ২৬০ থেকে ২৭০ কোটি ঘনফুট। গ্যাসের কারনে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান ঠিক মত উৎপাদন করতে পারছে না। ভারত এবং মায়ানমারের সাথে সমুদ্র সীমা নিষ্পত্তি হয়েছে ১১ বছর আগে । অথচ এখনো আমরা বঙ্গোপসাগরে কোন তেল গ্যাস আবিস্কার করতে পারি নি। এটা দেশের জন্য দু:খজনক।

অর্থসূচকঃ আপনিতো ২০ বছরের বেশি জ্বালানি খাত কভার করেন। কিভাবে তুলনা করবেন।

শাহেদ সিদ্দিকীঃ ভালো প্রশ্ন। বিএনপি সরকার আমলে আসলে এ খাতে কোন উন্নয়ন হয়নি। এক টঙ্গী  ছাড়া কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র ৫ বছরে হয়নি। মনে আছে ১০/১২ ঘন্টা লোডশেডিং হত। গ্যাস খাতে বিবিয়ানা ক্ষেত্র থেকে ভারতে গ্যাস রপ্তানির জন্য বিএনপি উঠে পড়ে লেগেছিল। এ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে ২০১০ সাল থেকে বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। কিন্তু সেগুলো হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। জ্বালানি খাতে বড় কোন উন্নয়ন করতে পারে নি। জ্বালানি বা গ্যাস খাতটি আমদানি নির্ভর হয়ে পড়েছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি খাত ঠিকমত না চললে দেশের জন্য বিপদ।

অর্থসূচকঃ আপনার অনেক রিপোর্টতো সরকারের পলিসি পরিবর্তন করতে সহায়তা করেছে। সে রকম কয়েকটি রিপোর্ট কি আমাদের জানাবেন।

শাহেদ সিদ্দিকীঃ ক্যারিয়ার শুরু ১৯৯৫ সাল থেকে। ২০০১ সালে ঢাকায় ভোরের কাগজে বদলি হয়ে আসি। তখন থেকে বড় স্টোরি করার জোঁক। কাগজটি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। ওই সময়ে কাজে অনেকটা প্রতিযোগিতাও ছিল। বড় স্টোরি করতেশুরু করি ২০০১ সাল থেকে। প্রথমে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির ওপর টানা আটটি সিরিজ করি। এতে বিএনপি সরকারের টনক নড়ে। বন্ধ হয়ে যায় ট্রেড ইউনিয়নের নামে লুটপাট। সবাই জানে তিতাস দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। ওই সিরিজের পর সরকারের সিস্টেম লস কমে আসে ১২ শতাংশ থেকে ৩ শতাঙশ। গ্যাস চুরি বন্ধ হয়ে সরকারের তখন রাজস্ব আয় বেড়ে যায় মাসে ২০০ কোটি টাকার বেশি। এভাবে ২০১৫ সালে টেলিকম খাতে সিরিজ নিউজ করি ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন এবং ইনডিপেনডেন্ট ইংরেজি দৈনিকে। সিরিজে দেখানো হয় জাল কাগজ পত্র দিয়ে অনেকে সিম কিনে সন্ত্রাসীরা মানুষকে হুমকি দিচ্ছে, চাদাঁবাজি করছে। এমন কি অনেকে এ রকম মোবাইল সংযোগ দিয়ে  সিম নম্বর ক্লোন বা মন্ত্রী এমপির এক্ নম্বর তৈরি করে বিভিন্ন জনকে ফোন করে চাদাবাজিঁ বা অপরাধ করা হত। আমার স্টোর পর দেশের প্রায় ৭ কোটি গ্রাহকের নতুন করে রেজিস্ট্রেশন করা হয়।

অনেক স্টোরির মধ্যে আরো একটি ইস্যু বলা যায়। ২০১৭ সালে আমিরাক অয়েল জায়ান্ট শেভরন বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নে। শেভরন চাইনিজ এক কোম্পানিকে বাংলাদেশের সম্পদ বিক্রির করার জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। আমি জানতে পারি একটি চক্র মার্কিন এ কোম্পানিকে ভুল বুঝিয়ে চাইনিজ কোম্পানির কাছে তাদের সম্পত বিক্রি করছে। এ নিয়ে ইনডিপেনডেন্ট নিউজ পেপারে একের পর এক নিউজ করলাম। নিউজে পেট্রোবাংলা বিষয়টি অনুসন্ধান করে শেভরনকে বুঝিয়ে এদেশে রেখে দিল। এতে করে বাংলাদেশ এবং মার্কি যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের লাভ হলো। নতুনবা বাংলাদেশের জ্বালানি খাত চাইনিজদের কব্জায় চলে যেত। তার থেকে আমার রিপোটর্ বাচিয়েছে।

অর্থসূচক আয়োজিত ক্যাপিটাল মার্কেট এক্সপোতে 'বিদ্যুৎ খাতের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ' শীর্ষক সেমিনার শেষে আলোচকদের সাথে সঞ্চালক শাহেদ সিদ্দিকী

অর্থসূচকঃ এখনো কি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করেন।

শাহেদ সিদ্দিকীঃ চেষ্টা করি। রিপোর্ট লিখি ইনডিপেনডেন্ট অন লাইনে। তবে এখন বেশি কাজ বড় টিম সামলানো। ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন দেশের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য টেলিভিশন। এ টিভির রিপোর্টিং টিম পরিচালনা করতে হয়। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে প্রায় ১০০ রিপোর্টার আছে। তাদের জন্য স্বল্প এবং দীর্ঘ মেয়াদের পরিকল্পনা করতে হয়। তাছাড়া প্রতিদিন রিপোর্টারদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করতে হয়। এটা আমার কাজ। সেই কাজের বাইরে একনো লেখা লেখি করি। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে যোগাযোগ ঠিক রাখি। নিজেকে রিপোর্টার পরিচয় দিতে পছন্দ করি। তবে ইচ্ছা আছে সামনে আরো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করবো । যাতে দেশের লাভ হয়, জনগণের লাভ হয়।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.