নতুন পদ্ধতিতেও ব্যাংকগুলোর ডলার কারসাজি বন্ধ করা নিয়ে শঙ্কা

ডলার বাজারের অস্থিরতার মধ্যেই কয়েকটি ব্যাংক কারসাজিতে জড়িয়ে পড়েছিলো। এসব ব্যাংকগুলোকে শাস্তির আওতায় এনেছিলো আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এরই মধ্যে সাম্প্রতি সময়ে ডলারের দাম নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই পদ্ধতিতে কিভাবে ডলারের দাম নির্ধারণ হবে তা এখনো ঠিক করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে আইনের সঠিক প্রয়োগ না করলে ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতেও ব্যাংকগুলোর ডলার কারসাজি বন্ধ করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ডলারের দাম ওঠা-নামা করবে। বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর আগে ডলারের দাম নির্ধারণে সাময়িক ভিত্তিতে এটি চালু করা হবে। আগামী মার্চের মধ্যে এই পদ্ধতি চালু করার পরিকল্পনা করছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। এর প্রভাব দেশের বাজারেও পড়েছে। যুদ্ধের শুরু থেকে দেশে ব্যাপক ডলার সংকট দেখা দেয়। এ সময় চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে। এর ফলে রিজার্ভ ব্যাপকহারে কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার কোটি ডলারের ঘরে।

ডলার সংকটের সুযোগে ২০২২ সাল থেকে কয়েকটি ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার সংরক্ষণ করে অতিরিক্ত মুনাফা করেছিলো। এসব ব্যাংকগুলোকে শাস্তির আওতায় এনেছিলো বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরেও নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি মূল্যে ডলার বিক্রি হচ্ছে অনেক ব্যাংককে। এক্ষেত্রে আমদানিকারকেরাও চাহিদা অনুযায়ী ডলার পাচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, বেশি দামে ডলার বিক্রি করলে সংশ্লিষ্টরা দায় এড়াতে পারবেন না। যখনই কোন ব্যাংক বেশি দামে ডলার বিক্রি করেছে আমরা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। সামনের দিনগুলোতেও সবাইকে নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে। এছাড়া ডলারের দাম নির্ধারণে নতুন ক্রলিং পেগ নিয়ে কাজ চলমান রয়েছে। শিগগিরই এই পদ্ধতি চালু করা হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

সর্বশেষ ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকারদের সংগঠন এবিবি ও বাফেদাকে ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপরও সংকট কাটেনি। ব্যাংক খাতে প্রতি ডলারের দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ টাকা হয়েছে। খোলাবাজারে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১২২ টাকা থেকে ১২৫ টাকায়।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে মার্কিন ডলারের দাম ওঠানামা করবে। আগে জোগান ও চাহিদার ওপর ভিত্তি করে দাম বাড়তো বা কমতো। নতুন পদ্ধতিতে দেশের অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে ডলারের দাম ওঠানামা করায় বেশি পার্থক্য থাকবে না।

দেশের কয়েকটি ব্যাংক ২০২২ সালে অতিরিক্ত ডলার সংরক্ষণ করে বেশি মুনাফা করেছিলো। এরফলে ঐ বছরের আগস্টে দেশি-বিদেশি ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে জরিমানা করেছিলো বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশি ব্যাংকগুলোর তালিকায় ছিলো- সিটি ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক এবং ব্র্যাক ব্যাংক। এর সঙ্গে শাস্তির মুখে পড়েছিলো বিদেশি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।

এরপর ২০২৩ সালের অক্টোবরে ডলার কারসাজিতে জড়িত থাকায় ১০ ব্যাংককে জরিমানা করেছিলো আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি মূল্যে আমদানিকারকের কাছে ডলার বিক্রির অপরাধে ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছিলো।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাফেদা ও এবিবির নির্ধারিত দামে অনেক ব্যাংক ডলার বিক্রি করতে পারেনি। কারণ নির্ধারিত দর বাস্তবভিত্তিক ছিলো না। ঐ দরে ডলার বিক্রি করলে ব্যাংকগুলোর ব্যবসা হচ্ছিলো না। এখন যদি ডলার নির্ধারণের নতুন পদ্ধতিও বাস্তবভিত্তিক না হয়, তাহলে সেটিও অকার্যকর হবে।

তিনি আরও বলেন, নির্ধারিত দামে ডলার বিক্রি করে অনেক ব্যাংক লাভ করতে পারছিলো না। তখন ব্যাংকগুলো বেশি দামে ডলার বিক্রি করছিলো। এরফলে কয়েকটি ব্যাংক বেশি দামে ডলার বিক্রি করে শাস্তির মুখে পড়েছিলো। সুতরাং ডলারের দাম বাস্তবভিত্তিক না হলে এরকম সমস্যা তৈরি হবে।

রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কেম যাওয়ায় দেশে ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। এরফলে আমদানি কমাতে কঠোর হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। প্রতিনিয়ত ডলারের দামে নতুন নতুন সিদ্ধান্ত আসছে। তারপরও সংকট কাটছে না।

ব্যাপকহারে ডলার সংকট দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলাস পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। বিভিন্ন উদ্যোগের পরেও ডলার বাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি।

অর্থসূচক/ মো. সুলাইমান/ এইচএআই

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.