মূল্যস্ফীতির লাগাম টানাই মুদ্রানীতির বড় চ্যালেঞ্জ

দেশের ব্যাংক খাতের অনিয়ম- দুর্নীতির লাগাম কোনভাবেই টেনে ধরা যাচ্ছে না। নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এ খাতটি। রেকর্ড খেলাপি ঋণ নিয়ে চলছে দেশের ব্যাংক খাত। গত কয়েক বছরে এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ডলার সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট। বাংলাদেশ ব্যাংক জানুয়ারি-জুন মেয়াদের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে আগামী সোমবার (১৫ জানুয়ারি)। এবারের মুদ্রানীতিতে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

বর্তমানে দেশের অন্যতম বড় সমস্যা মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি। সদ্য সমাপ্ত ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা নয় মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে ছিলো। ২০২৩ সালে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ও সার্বিক মূল্যস্ফীতি দুটোই রেকর্ড গড়ে। গত বছরের আগস্টে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে উঠেছিলো ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে। এর আগে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশ। একই বছরের মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে উঠেছিলো। এর আগে ২০১২ সালের মার্চে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল।

অপরদিকে দেশে প্রায় গত দুই বছর ধরে চলছে ডলার সংকট। ২০২৩ সালে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এর ফলে প্রতি ডলারের দাম ব্যাংকে ১১০ টাকায় ঠেকেছে। তবে খুচরা বাজারে বর্তমানে প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছে ১২২ থেকে ১২৫ টাকায়। ডলার সংকটের প্রভাবে অনেক ব্যাংক ঠিকমতো এলসি খুলতে পারেনি। ডলার চাহিদা দিন দিন আরও বাড়ছে।

ডলার সংকট শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশ। এরপর গত বছরের শুরুর দিকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। সে বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। এরপর সদ্য সমাপ্ত ডিসেম্বরে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার দেশের রিজার্ভ যুক্ত হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক অর্থসূচককে বলেন, মুদ্রানীতিতে যেসব বিষয় গুরুত্ব দেওয়া হবে তা এখনই বলা যাবে না। এক্ষেত্রে কিছুটা বাধ্যবাধকতা রয়েছে। মুদ্রানীতি ঘোষণার দিন সবকিছু বিস্তারিত জানতে পারবেন।

এদিকে দেশের ব্যাংক খাত এখন তারল্য সংকটে ভুগছে। প্রতি কার্যদিবসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করছে তারল্য সংকটে থাকা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। অপরদিকে অনেক ব্যাংক এখন সরকারি ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ করছে। সরকারি ট্রেজারি বিলের সুদের হার ১১ দশমিক ১৫ শতাংশে উঠেছে।

ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতি ও তারল্য সংকট সমাধানের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ফলপ্রসূ কোন উদ্যোগ নিতে পারেনি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য গত বছরের শেষের দিকে এসে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে ঋণের সুদহার। বর্তমানে নীতি সুদহার ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ ও বড় অঙ্কের ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এরপরও বর্তমানে দেশের সাধারণ মানুষের প্রধান সমস্যা মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে পারেনি আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অর্থসূচককে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে এখন মূল চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি। সুতরাং এবারের মুদ্রানীতিতেও পলিসি রেট বা নীতি সুদহার বাড়ানো হবে। কারণ টাকাকে শক্তিশালী করে মূল্যস্ফীতি কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

অন্যদিকে রেকর্ড খেলাপি ঋণে ভর করে চলছে দেশের ব্যাংক খাত। গত বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে রেকর্ড ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ছিলো। এরপর সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমে ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। অপরদিকে বেশ কয়েকটি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা প্রতিনিয়ত খারাপ হচ্ছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। এর আগে জুন শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা।

আগামী শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি চূড়ান্ত করার আগে কমিটির একটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। নতুন মুদ্রানীতি কমিটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বাইরে থেকে তিনজনকে রাখা হয়েছে। বাইরে থেকে কমিটিতে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান মাসুদা ইয়াসমীন, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন এবং অর্থনীতিবিদ সাদিক আহমেদ। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রয়েছেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারসহ মুদ্রানীতি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালক ও পরিচালক।

 

অর্থসূচক/ মো. সুলাইমান

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.