অকার্যকর পরিকল্পনা, ব্রহ্মপুত্রের মৃত্যু এবং অতঃপর : মোখলেছুর রহমান

প্রায় ৫ কোটি বছর আগে গন্ডেয়ানাল্যান্ডের টেকটোনিক প্লেটের মহাসংঘর্ষে তৈরি হয় হিমালয় পর্বতমালা, ভারত ও আমাদের এই বাংলাদেশ। ব্রহ্মপুত্র নদ হিমালয় পর্বতমালার কৈলাস শৃঙ্গের নিকটে মানস সরোবরের আঙ্গসি হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয় এবং তিব্বত, অরুণাচল ও আসামের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার পাখিউড়া গ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এটি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন প্রবাহ। গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার পাগলার চর হয়ে ব্রহ্মপুত্র দেওয়ানগঞ্জের কাছে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে জামালপুর ও ময়মনসিংহ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভৈরববাজারের দক্ষিণে এসে মেঘনায় পড়েছে।

ব্রহ্মপুত্রের মোট দৈর্ঘ ৩,৮৪৮ কি.মি., যার মাত্র ৮.২% বাংলাদেশে। ব্রহ্মপুত্রের অবস্থান ১০০ থেকে ১৮০ কি.মি. পুরু টেকটোনিক প্লেটের উপর। এর অববাহিকায় অবস্থিত স্থানসমূহ পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেব বিবেচিত। ১৯২০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ৬৮ বছরে এই অববাহিকায় ৫-৮ রিখটার স্কেলে মোট ৪৬৪ বার ভূমিকম্প হয়েছে। ফলে ব্রহ্মপুত্রের একাধিক উপনদী ও শাখানদী সৃষ্টির মাধ্যমে প্রবাহে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। অনেক নদ-নদীর তলদেশ উঁচু হওয়ায় স্বভাবিক জলপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করেছে। বিশেষত ১৭৬২ সালে ৭.৫ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্প ব্রহ্মপুত্রের গতিপথে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে বলে বিজ্ঞানীদের মত। এই ভূমিকম্পের ফলে ব্রহ্মপুত্রসহ অনেক নদীর তলদেশে উঁচু হয়ে যায়। অধিকন্তু আমাদের অনাদর, অবহেলা ও অনাচারে ব্রহ্মপুত্র এখন বিপন্নপ্রায় মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র কখনো এর দিকে সুদৃষ্টিতে ফিরে তাকায়নি। যদিও আদালত ২০১৬ সালে নদীকে জীবন্ত সত্ত্বা বলে স্বীকৃতি দিয়েছে।

হিন্দুকুশ হিমালয় অঞ্চল ৩,৫০০ কিলোমিটারেরও অধিক দীর্ঘ এবং ৮টি দেশ অর্থাৎ আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, চীন, ভারত, নেপাল, মায়ানমার এবং পাকিস্তান সমন্বয়ে গঠিত। এই অঞ্চল বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘ওয়াটার টাওয়ার’ হিসেবে স্বীকৃত এবং এশিয়ার বৃহত্তম ১০টি নদীর উৎস। ব্রহ্মপুত্র এদের মধ্যে অন্যতম। এই নদ পাহাড় ও নিম্নধারায় বসবাসকারী ১.৩ বিলিয়ন মানুষের পানীয় জল, সেচ, শক্তি, শিল্প এবং স্যানিটেশন চাহিদাগুলিকে পূরণ করে। বাংলাদেশ হিন্দুকুশের নিম্নধারারভূক্ত একটি দেশ। ব্রহ্মপুত্র কেবল আমাদের সম্পদ নয় – চীন ও ভারতেরও বটে। তাই পরিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা করতে হলে আন্তঃদেশীয় জলকূটনীতিতে আমাদেরকে অগ্রগামী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ভারতের অরুণাচল ও আসাম রাজ্য ব্রহ্মপুত্রকে চমৎকার ব্যবস্থাপনায় আওতায় এনেছে। একইভাবে চীনের একাডেমি অব সায়েন্সেন এই নদী ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ ঘটিয়ে এর সর্বোত্তম সুরক্ষা ও পরিরক্ষার কাজ পরিচালনা করছে। ফলে নদী ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রকে শিক্ষা, প্রযুক্তি, কূটনীতি ও সর্বোপরি রাজনৈতিক দৃঢ়তা আবশ্যক।

ব্রহ্মপুত্রের পৌরাণিক তথ্য ও লোক-সংস্কৃতি
ব্রহ্মপুত্রের উৎস কাহিনী নিয়ে লোককথন, কিংবদন্তী ও কল্পকাহিনীর শেষ নাই। ব্রহ্মপুত্রকে অসংখ্য নামে ডাকা হয়। উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত উভয় পাড়ের মানুষ তাদের নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির আলোকে একে নানা নামে অভিহিত করেছে। ব্রহ্মপুত্র বিপদসংকুল সুউচ্চ পর্বতমালা থেকে প্রচণ্ড বেগে ধাবিত হয়ে নিম্ন সমতলে এক কুণ্ড সৃষ্টি করে। পৌরাণিক মতে, তাই এই স্থানের নাম দেওয়া হয় ব্রহ্মকুণ্ড। এখান থেকে ব্রহ্মপুত্র নামের উৎপত্তি বলে অনেক মনে করেন। এর পানি অনেকটা লাল বর্ণের ছিলো। তাই মহাভারতে একে লৌহিত্য নদ বলে অভিহিত করা হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের আরেকটি পৌরাণিক নাম হৃদিনী। সনাতন বিশ্বাস মতে, এই নদ সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার পুত্র। তাই এর নাম ব্রহ্মপুত্র। তিব্বতে এই নদকে সাংপো, ভারতের অরুণাচলে ডিহাং এবং আসামে প্রবেশের পর একে লুইত নাম প্রদান করা হয়। সবশেষে আসামে এই নদ ব্রহ্মপুত্র নাম ধারণ করে। মরক্কোর খ্যাতনামা পর্যটক ইবনে বতুতা একে নীলনদ বলে অভিহিত করেছিলেন। এসব বিষয় থেকে সহজেই অনুমিত হয় যে, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্রহ্মপুত্রের ঐতিহাসিক অবস্থান অত্যন্ত সুদৃঢ়।

বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ব্রহ্মপুত্র
নদী একটি প্রকৃতির এক অমোঘ দান, প্রাকৃতিক মূলধন। নদী সৃষ্টি করা যায় না। বরং নদী দেশ-জনপদের জন্য ভূমি ও ভূমিরূপ সৃষ্টি করে। প্রত্নতত্ত্ববিদগণের মতে, বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটি ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার জলে পরিপুষ্ট হয়ে জন্মলাভ করা এক সবুজ শ্যামল মায়াবতী ব-দ্বীপ। গবেষকগণ বলছেন যে, ব্রহ্মপুত্র বছরে ৭২১ মিলিয়ন টন তলানী বহন করে, যা থেকে বছরে নদের তলদেশ ৩.৬৫ মিমি উঁচু হয়। আরো উল্লেখযোগ্য খবর এই যে, ব্রহ্মপুত্র এককভাবে ১৯,৮০০ ঘনমিটার পানি বহন করে। তাই এই নদ অত্যন্ত ভাঙ্গনপ্রবণ। এইসব তথ্য থেকে সহজেই বুঝা যায় যে, ব্রহ্মপুত্রের সাথে বাংলাদেশের নৃ-তাত্ত্বিক সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর।

নদীর সংজ্ঞা, সংখ্যা ও নিষ্ঠুরতা
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশের নদ-নদী: সংজ্ঞা ও সংখ্যা পুস্তিকায় নদীর সংজ্ঞায় বলেছে যে, নদী বা নদ বলিতে পাহাড়, পর্বত, হিমবাহ, হ্রদ, ঝরণা বা অন্য কোন জলাশয় হইতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হইয়া যে জলধারা সারা বছর বা বছরের কোন কোন সময় দুই তীরের মধ্য দিয়া প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হইয়া সমুদ্র, মহাসমুদ্র, হ্রদ, অন্য কোন জলাশয় বা অন্য কোন জলধারায় পতিত হয় তাহাকে বুঝায়; তবে শর্ত থাকে যে, উপর্যুক্ত সংজ্ঞায় যাহাই থাকুক না কেন ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে, রিভিশনাল সার্ভে ও বাংলাদেশ রিভিশনাল সার্ভে রেকর্ডে নদ বা নদী হিসাবে যাহা উল্লেখকৃত হইয়াছে তাহা নদ বা নদী হিসাবে গণ্য হইবে। এই সংজ্ঞার অধীন নদী রক্ষা কমিশন উক্ত পুস্তিকায় ১,০০৮টি নদীর তালিকা প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ হাওর ও জালাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর ডিসেম্বর ২০১৬ সালে প্রণীত নদীর তালিকায় বাংলাদেশে মোট নদীর সংখ্যা ৪০৫টি বলে উল্লেখ করেছে। তবে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন কর্তৃক বাংলাদেশের আরো প্রায় ১,৬০০ নদীর অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। রাষ্ট্রের এই ২টি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান নদীর সংখ্যা ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে এইরূপ বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করলে তা জনমনে হতাশা ও ক্ষোভ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক বটে। মজার বিষয় এই যে, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরশেনসহ বেশ কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নদীর অবৈধ দখলদার হিসেবে উল্লেখ করেছে।

বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীসমূহের সুরক্ষার কৌশল আমাদের অজানা। কারণ এই দেশের কোন উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নদী ও জলাভূমি নিয়ে পাঠদানের গুরুত্বকে আমলে নেয়া হয় নাই। আমাদের শিক্ষক, গবেষক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, নীতি-নির্ধারক মহল, রাজনীতিবিদ ও কোন শাসক গোষ্ঠী নদী কিংবা জলাভূমিকে আমাদের জাতীয় সম্পদ ও জীবনাধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে কুন্ঠাবোধ করেছেন।। কেবল সাধারণ মানুষ বিপদে পড়লে কিছু সভা কিংবা প্রতিবাদ হয়, তাতে একে রক্ষার জন্য সকলেই একমত পোষণ করে। বরং নদীকে সরকারিভাবে কখনো বদ্ধ জলাশয়, কখনো খাল ইত্যাদি বলে মাইলের পর মাইল নদী আইনি মোড়কে বেআইনিভাবে ব্যক্তির মালিকানা প্রদান করা হয়েছে। নদী দখল করেছে সরকার, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিত্তশালী দূর্বৃত্ত এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের সহস্রাধিক নদী কীভাবে এই প্রবাহ হারালো, দখল হয়ে গেলো কিংবা দূষণ করা হলো – তার কোন কোন সদুত্তর পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্রের প্রধান প্রধান উপনদী ও শাখানদী
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, ব্রহ্মপুত্রে রয়েছে ১৩টি উপনদী ও ৫টি শাখানদী। বাংলাদেশের ভিতরে ধরলা ব্রহ্মপুত্রের অন্যতম প্রধান উপনদী। বাংলাদেশের অংশে ধরলার দৈর্ঘ ৭৫ কি.মি.। ব্রহ্মপুত্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপনদীর নাম তিস্তা। বাংলাদেশে এর দৈর্ঘ ১১২ কি.মি.। ময়মনসিংহ অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র মিরগী নামক উপনদীর সাথে যুক্ত, যার দৈর্ঘ ৬২ কি.মি.। এ ছাড়া কুড়িগ্রামে অবস্থিত ৫৬ কি.মি. দীর্ঘ গিরাই উপনদী নব্যতা হারিয়েছে। একই জেলায় রয়েছে ২০ কি.মি. দীর্ঘ গঙ্গাধর-দুধকুমার উপনদী। নীলফামারি জেলায় ঘাগট নামক আরেকটি উপনদী রয়েছে, যার দৈর্ঘ ১৯২ কি.মি।

জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলায় ঝিনাই নামে রয়েছে ব্রহ্মপুত্রের ১৩৩ কি.মি. দীর্ঘ একটি শাখানদী। এই জেলার আরেকটি শাখানদীর নাম আইমান-আখিলা; দৈর্ঘ ৬১ কি.মি.। ময়মনসিংহে রয়েছে বানার নামে ১টি শাখানদী আছে ব্রহ্মপুত্রের, যার দৈর্ঘ ৯৬ কি.মি.। সুতিয়া বা মাহারি নামে ময়মনসিংহে রয়েছে আরো একটি শাখানদী, যার দৈর্ঘ ৩৭ কি.মি.। শীতলক্ষ্যা ব্রহ্মপুত্রের একটি অন্যতম শাখানদী; দৈর্ঘ ১০৮ কি.মি.। কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা ব্রহ্মপুত্রের গুরুত্বপূর্ণ শাখানদী, যার দৈর্ঘ ৫৭ কি.মি.। নরসিংদী জেলার আড়িয়াল খাঁ ব্রহ্মপুত্রের আরেকটি শাখানদী, যার দৈর্ঘ ৬০ কি.মি.।ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার কৃষি সংস্কৃতি ও জীবনধারা
পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল অববাহিকা হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র। তাই প্রবহমান জলধারা উভয় পাড়ে প্লাবনের মাধ্যমে ঢেলে দিচ্ছে বিস্তীর্ণ পলি স্তর। এই কারণে এর মাটি বিশ্বের সেরা উর্বর অঞ্চলগুলির মধ্যে অন্যতম। ফলে বাংলাদেশ উষ্ণমণ্ডলীয় দেশ হিসেবে পেয়েছে বিপুল প্রাকৃতিক আশীর্বাদ। আমাদের দেশে ধান, পাট, গম, ডাল, চা, বিভিন্ন ধরণের ফল ও সব্জিসহ নানাবিধ ফসল বিপুল পরিমাণে উৎপাদিত হয় ব্রহ্মপুত্রের আশীর্বাদে।

পাটবস্ত্রের ব্যবহার, গুণ ও আকর্ষণের কথা গুপ্ত যুগের কাব্য, চণ্ডীমঙ্গল কাব্য এবং মনসামঙ্গল কাব্যে নানা বর্ণনায় উৎকীর্ণ। ময়মনসিংহ অঞ্চলে কবে পাটচাষ শুরু হয়, তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে ১৭৯১ সালে বেঙ্গল বোর্ড অব ট্রেড-এর উদ্যোগে লন্ডনে পাটের নমুনা পাঠানো হয়। ফলে ১৭৯৩ সালে লন্ডনে ১,০০০ টান পাট রপ্তানি করা হয়। ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় উৎপাদিত দার্জিলিং চায়ের কথা পৃথিবীব্যাপি সকলেই জানেন। বাংলাদেশের পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁয়ে ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় এখন দার্জিলিং ব্রান্ডের চা উৎপাদিত হচ্ছে। আগর নামক সবচেয়ে সুগন্ধি মূল্যবান কাঠ জন্মায় এর অববাহিকা জঙ্গলে। খ্রিষ্টীয় ৮ম শতকে আরব বণিকরা আগর কাঠের সন্ধান পেয়েছিল। এই কাঠ থেকে আতর ও অন্যান্য সুগন্ধি তৈরি হয়।

বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি ও জীবনধারা গড়ে উঠার পিছনে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় গড়ে উঠা কৃষির অবদান প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত। প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে এর পানিতে মৎস্যচাষ ও পলি সমৃদ্ধ অববাহিকায় কৃষি ফসল উৎপাদন বাংলাদেশে এক প্রাকৃতিক স্নিগ্ধ জীবন ব্যবস্থা প্রদান করেছে। বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের জেলাগুলিতে জন্ম নিয়েছেন কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, দার্শনিক এবং বহু সংখ্যক সৃজনশীল ক্ষণজন্মা মানুষ। তাঁরা বাংলার শিল্প ও সাহিত্যে অনবদ্য অবদান রেখে অমর হয়েছেন।

অকার্যকর পরিকল্পনা ও ব্রহ্মপুত্রের মৃত্যু
ব্রহ্মপুত্র অস্তিত্ব সংকটে পড়তে থাকে ১৯২০ সাল থেকে। ভূমিকম্প ও উজানের দেশগুলি কৃত্রিমভাবে পানির প্রবাহের হ্রাস টানা এবং সর্বোপরি নদী ব্যবস্থাপনায় আমাদের অজ্ঞতা ও উদাসীনতা ব্রহ্মপুত্রেকে ক্রমেই সংকটাপন্ন করে তুলেছে। নদী বিষয়ে আমাদের দেশে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ের সমঝদার ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠায় ব্রহ্মপুত্রের সংকটগুলিকে সুবিবেচনায় নেওয়া সম্ভব হয় নাই। পানির প্রবাহ, ওয়াটার শেডের প্রভাব, নদী ভাঙ্গনের বৈজ্ঞানিক কারণ ইত্যাদি বুঝে ও গবেষণার মাধ্যমে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নাই। তাই ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের মানুষদের ক্রমাবণতি হতে থাকে। তবে অবস্থা আরো বেগতিক হলে ২০০৯ সালে ব্রহ্মপুত্র ড্রেজিংয়ের দাবিতে ময়মনসিংহে আন্দোলনের সূচনা হয়। ময়মনসিংহ জেলা নাগরিক আন্দোলন জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে ব্রহ্মপুত্র নদের হেডওয়াটার পরিদর্শন করে সরকারের কাছে কতিপয় বাস্তবোচিত সুপারিশ করে। কিন্তু তা আমলে না নিয়ে ২০১৯ সালে ব্রহ্মপুত্র নদের ড্রেজিংয়ের উদ্দেশ্যে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। উদ্দেশ্য হলো নাব্যতা বজায় রাখা, যাত্রী ও পণ্য বোঝাই জাহাজগুলির নদীতে চলাচল নিশ্চিত করা এবং স্থানীয় কৃষি ও মৎস্য সম্পদের উন্নয়নকে পুনরুদ্ধার করা।

কিন্তু ড্রেজিং প্রকল্পে পুরো নদের কোন স্থানে কতটুকু গভীরতায় ও কতটুকু প্রশস্ত করে কাটা হবে, কোন কোন মাসে খনন চলবে, নদের উত্তোলিত মাটি ও বালু কোন স্থানে কীভাবে সংরক্ষণ করা হবে ইত্যাদি বিষয়গুলি অনুসরণ না করার জন্য চরম অব্যবস্থপনায় ব্রহ্মপুত্র নদ আরো আশংকাজনক অবস্থা ধারণ করেছে। সংগৃহিত ড্রেজিংয়ের বালু ও মাটি নদের পাড়ে স্তুপ করা রাখা হচ্ছে। যা বর্ষাকালে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে। ময়মনসিংহ থেকে দক্ষিণে আহম্মদবাড়ি এলাকায় এই দৃশ্য এখনো মূর্তমান। ড্রেজিংয়ের অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদে গত ৫ মে ২০২৩ তারিখে ময়মনসিংহ শহরে ও পাশাপাশি কয়েকটি উপজেলার যুবকরা ‘মৃতের চিৎকার’ নামে একটি প্রতিবাদ অনুষ্ঠান করে। তারা বলে যে, ব্রহ্মপুত্রের মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ অবহেলা ও অকার্যকর ড্রেজিং কার্যক্রম নদটিকে মেরে ফেলেছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকা জলে ভেসে যাচ্ছে।

নাব্যতা হ্রাসের পাশাপাশি ব্রহ্মপুত্রের দখল ও দূষণ বাড়ছে। ময়মনসিংহ শহরের নোংরা পানি ব্রহ্মপুত্রে নেমে যাওয়ার জন্য সিটি কর্পোরেশন প্রায় দেড় ডজন নালারূপী জনপ্রপাত তৈরি করেছে। যার মাধ্যমে ময়মনসিংহ শহরের দূষিত পানি ঝর্ণার ধারার মতো প্রতিনিয়ত ব্রহ্মপুত্রের দেহে পড়ছে। বলতে দ্বিধা নাই যে, বিভিন্ন স্থানে তৈরি এই সকল নোংরা জলপ্রপাত স্থানীয় সরকারের এক মহাপ্রজ্ঞাপরাধের ফল। এতে ব্রহ্মপুত্রে জলপ্রবাহ ব্যাপকভাবে দূষিত হচ্ছে। নদের বাস্তু পরিবেশ নষ্টের জন্য মাছ ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণির আবাস হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। অধিকন্তু সরকারের এমন কোন নদী সংরক্ষণ পরিকল্পনা নাই যা দিয়ে ব্রহ্মপুত্র, এর শাখা ও উপনদী এবং খালগুলিকেকে রক্ষা করা যায়। ফলে শাখা নদীগুলি ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে, যা ব্রহ্মপুত্রের বিপর্যয়ে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে সরকার ময়মনসিংহ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া জীর্ণকায় ব্রহ্মপুত্রের অপর পাড়ে নদ দখল করে সৌর-বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করছে।

গত ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ-প্রতিবেশ জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে ৬ জনের একটি অনুসন্ধানী দল দেওয়ানগঞ্জ বাজার থেকে দূরবর্তী চরাঞ্চলের বালুকাময় পথে প্রায় ১০ কি.মি. হেঁটে যমুনার সাথে ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থলে গমন করেন ব্রহ্মপুত্রের বর্তমান বাস্তব চিত্র অবলোকন করার জন্য। স্থানীয় মানুষ ও ভুক্তভোগীরা জানান যে, পাগলার চর, সন্ন্যাসীর চর, হরিচণ্ডি, চর বাহাদুরাবাদ এবং পল্লাকান্দি সেতু পর্যন্ত প্রায় ১৪ কি.মি. ব্রহ্মপুত্র এখন শতভাগ জলশুন্য। ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ ধরে রাখতে হলে এই ৫টি স্থানে অন্তত ২৫০-৫০০ মিটার প্রশস্ত ও প্রয়োজনীয় গভীরতায় ড্রেজিং করতে হবে। পলি জমা রোধ করার জন্য উচ্চ প্রবাহমান নদের উভয় পাড়ে সংরক্ষণ করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন বলে এলাকাবাসীরা মনে করেন। নইলে পানির তীব্র প্রবাহ নদের পাড় ভাঙবে এবং দ্রুত পলি সঞ্চয় করে আবার নদ ভরাট করে ফেলবে। এই নদের উচ্চগতির প্রবহমানতার জন্য এই ড্রেজিং নিয়মতিভাবে অব্যাহত রাখতে হবে। সর্বোপরি পুরো বিষয়টি নিয়ে অনুমানভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ না করে গবেষণা প্রসুত কার্যকর পন্থা অবলম্বন করা একান্ত প্রয়োজন। এলাকার বাসিন্দাগণের গণমত হলো ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ সারা বছর অব্যাহত বজায় রাখতে হলে দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর চর দাদনা সেতু হয়ে জামালপুর পর্যন্ত ৪৬ কি.মি. নদ খনন অত্যন্ত জরুরি। অর্থাৎ পাগলার চর থেকে জামালপুর পর্যন্ত কমপক্ষে ৬০ কি.মি. ব্রহ্মপুত্রের পূর্ণ খনন, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা অত্যাবশ্যক। অনুসন্ধানী দলের পর্যবেক্ষণ ও স্থানীয় মানুষের এই সকল অভিজ্ঞতা থেকে সারকথা হলো ব্রহ্মপুত্রের গবেষণা, স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তিবিদদের কারিগরি মতামতের সংমিশ্রণে একটি কার্যকর ও টেকসই ব্রহ্মপুত্র সংরক্ষণ পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বেঁচে যাবে দেশ ও মানুষ।
উল্লেখ্য যে, ইতোপূর্বে আশির দশকে ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখে পাগলার চর ও সন্ন্যাসীর চরে খনন করা হয়। কিন্তু তা সঠিক পদ্ধতিতে না করার জন্য নদের ব্যাপক পাড় ভাঙন ঘটে। এলাকার মানুষের প্রচুর ক্ষতি হয় এবং সবশেষে দ্রুত নদী ভরাট হয়ে বর্তমানের ১৪ কি.মি. নদ সম্পূর্ণ নাব্যতা হারায়।
ব্রহ্মপুত্র খননে লুটপাটের বর্তমান চিত্র
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ২০১৯ সালে গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার পাগলার চরে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমস্থল থেকে গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার টোক পর্যন্ত ২২৭ কিলোমিটার এলাকা ড্রেজিং করার জন্য ৪ বছর মেয়াদি মোট ২,৭৬৩ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের একটি বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কর্তৃপক্ষ বলছে যে, ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৪৬% কাজ শেষ হয়েছে এবং আগামী জুন ২০২৪ মাসে প্রকল্পটি সমাপ্ত হবে। কিন্তু প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ-প্রতিবেশ জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে একটি অনুসন্ধানী দল গত ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে পাগলার চর থেকে গফরগাঁও পর্যন্ত প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানের মাধ্যমে দেখতে পায় ৫% কাজও করা হয় নাই। ফলে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, ব্রহ্মপুত্র খনন প্রকল্পের অন্তত ৯৫% অর্থ লুটপাট করা হয়েছে। এই লুটপাটের উৎস এবং সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গের অনুসন্ধান করা একটি জাতীয় দায়িত্ব বলে মনে হয়। অন্যথায় রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় জনগণের করের টাকার এই শ্রাদ্ধ এবং এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে ব্রহ্মপুত্রের চিরপ্রয়াণ নিশ্চিত হয়ে যাবে। তাই জনগণের অর্থরক্ষা ও প্রকৃতির অমোঘ উপহার ব্রহ্মপুত্রকে রক্ষার মাধ্যমে এর ৩৩৭ কি.মি. তটরেখায় বসবাসকারী মানুষের অস্তিস্ত রক্ষার সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসা অতীব জরুরি।

ব্রহ্মপুত্র রক্ষা ও উৎকর্ষ সাধনে কতিপয় প্রস্তাবনা
এই অবস্থায় স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের প্রয়াস আমাদেরকে মুক্তি দিতে পারে। এই ভাবনা থেকে নিচের ৮টি বিষয় আপনাদের আলোচনা, সমৃদ্ধিকরণ ও বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করা হলো:

১. ব্রহ্মপুত্র নদ খননের অগ্রগতি পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের জন্য একটি মনিটরিং ছায়া টিম (গড়হরঃড়ৎরহম ঝযধফড়ি ঞবধস) গঠন করা, যা নিয়মিতভাবে ব্রহ্মপুত্রের নাব্যতা পরিমাপসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উপর প্রত্যক্ষ মনিটরিং অব্যাহত রাখবে। এই বিষয়ে ৩ মাস পর পর একটি মনিটরিং সভা অনুষ্ঠান করাও জরুরি।
২. সংবাদকর্মী ও মিডিয়াকে সম্পৃক্ত করে একটি একটি মিডিয়া টিম গঠন করা, যারা নিয়মিতভাবে ব্রহ্মপুত্রের সর্বশেষ অবস্থা গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করবে।
৩. মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে নদী বিষয়ক পাঠ্যক্রম তৈরি করে তা পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করার জন্য একটি নদী বিষয়ক শিক্ষা টিম গঠন করা।
৪. বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে বিশ্ববিদ্যালসমূহে নদীবিজ্ঞান বিষয়টি চালুর জন্য পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাবনা প্রেরণ করা। উল্লেখ্য যে, ভারতের কাবেরী নদী অধ্যয়নের জন্য কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে এক বছর মেয়াদি একটি কোর্স চালু করেছে।
৫. নদী বিষয়ক লেখক, গবেষক, পাঠদানকারী, বিজ্ঞানী ও শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে প্রতি ৬ মাস পর পর একটি জাতীয় কনফারেন্সের আয়োজন করা।
৬. ব্রহ্মপুত্রের অগ্রগতি, উন্নয়ন, তীরের মানুষের অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ইত্যাদি অবলোকন এবং নদীর বিজ্ঞোচিত ব্যবহার বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার জন্য প্রতি ৩ মাস পর পর নৌপর্যটন পরিচালনা করা।
৭. মানুষের সকল সাধারণ ও ঐতিহ্যগত সম্পদের সংমিশ্রণে নদীকেন্দ্রিক জীবনধারা উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে একটি গবেষণা সেল তৈরি করা।
৮. ব্রহ্মপুত্রকে কেন্দ্র করে সফল জল কূটনীতির সূচনা করা, যা আমাদেরকে হিন্দুকোষ হিমালয় অঞ্চলের দেশগুলির সাথে যৌথভাবে বাংলাদেশের সকল নদীর সংরক্ষণ ও পরিরক্ষণে ভূমিকা রাখবে।

প্রান-প্রকৃতি-পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য মোখলেছুর রহমানের এ প্রবন্ধটি শনিবার (৩০ ডিসেম্বর)  ময়মনসিংহের জেলা পরিষদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত
নাগরিক মতবিনিময় সভায় পাঠ করা হয়।

 

অর্থসূচক/এমআর

 

 

 

 

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.