৫২ বছরে নড়বড়ে আর্থিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো

দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এখনো নানা অনিয়মে জড়িত। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে পারস্পরিক যোগসাজশে বেনামে ঋণ দিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে রাষ্ট্রের এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে। আর্থিক কেলেঙ্কারি আর চরম অব্যবস্থাপনায় ৫২ বছর পার করে এখন নড়বড়ে আর্থিক পরিস্থিতিতে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে এ ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ২১ দশমিক ৭০ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এর আগে জুনে খেলাপি ২৫ শতাংশে ঠেকেছিলো। ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষেও এ ব্যাংকগুলোর খেলাপির হার ছিল ২০ শতাশে।

তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৩ লাখ ৩ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬৫ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকাই ছিল খেলাপি, যা বিতরণকৃত ঋণের ২১ দশমিক ৭০ শতাংশ। ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষেও রাষ্ট্রায়ত্ত এ ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫৬ হাজার ৪৬০ কোটি টাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। ওই সময় ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ২০ দশমিক ২৮ শতাংশ ছিল খেলাপির খাতায়। মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে এসব ব্যাংকের ৯ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা নতুন করে খেলাপি হয়েছে।

সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। আর অগ্রণী ব্যাংকের ১৬ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে। এছাড়া সোনালী ব্যাংকের ১৩ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা, রুপালী ব্যাংকের ৮ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের ৮ হাজার ২০৯ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৯৯১ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে।

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর অর্থসূচককে বলেন, একটা সময় ব্যাংক সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। এরপর ব্যাংক খাতের খেলাপি অনেকটা কমে এসেছিলো। এরপর আবার ২০১১ সাল থেকে খাতটিতে অনিয়ম আবার বাড়তে থাকে। এখানে করপোরেট গভর্ন্যান্সের ঘাটতি রয়েছে। তাই এসব সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হয়। সামনের নির্বাচনের পর হয়তো সরকার ব্যাংক খাতের সংস্কারে কাজ করবে। কারণ আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক সহ অনেকের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া যাবে। তবে এসব ক্ষেত্রে সরকারের সঠিক ইচ্ছে থাকাটা জরুরী। তাছাড়া এসব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব না।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের ব্যাংক খাত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলেছে, আর্থিক খাতের সংস্কার জরুরি। ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি কমাতে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানোর পাশাপাশি পুঁজি পুনরুদ্ধারে বিশেষ কৌশল প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি। পরিচালকেরা এ বিষয়ে একমত যে ব্যাংক খাতের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো জোরদার করা এবং শাসনব্যবস্থার উন্নতি করা গেলে আর্থিক খাতের দক্ষতা বাড়বে।

এদিকে আইএমএফ ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলেছে। এখন বেসরকারি খাতের বেশির ভাগ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের কম হলেও সরকারি খাতে তা ২০ শতাংশের বেশি।

সম্প্রতি আহসান এইচ মনসুর একটি অনুষ্ঠানে বলেন, দেশের আর্থিক খাত নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সব সূচকই আর্থিক খাতের নিম্নমুখী ইঙ্গিত দিচ্ছে। বাংলাদেশ বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এই কর্মসূচিকে সময়োপযোগী বলে অভিহিত করেছেন তিন।

তিনি মনে করেন, দেশের টাকার প্রয়োজন নেই। বরং আইএমএফ যে নীতিগত সংস্কারের কথা বলেছে, তা প্রয়োজন। দেশের উচিত নিজের স্বার্থে অর্থনীতির সংস্কার করা।

অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে প্রধান করে গঠিত ব্যাংক সংস্কার কমিটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল ১৯৯৯ সালে। কমিটি তাদের রিপোর্টে বলেছিল, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহ রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা বণ্টনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হইয়াছে, যাহাও খেলাপি ঋণের অন্যতম কারণ। স্বার্থান্বেষী ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীসমূহের বিরোধিতা ব্যাংকিং খাত সংস্কারের সম্ভবত সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। এ কারণে সংস্কার কর্মসূচি সফল করতে হলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে যার পরিমাণ ২১ হাজার কোটি টাকা বেশি। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা।

করপোরেট গভর্ন্যান্স ও খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতের বড় দুই সমস্যা। ব্যাংক খাতে প্রধান এ সমস্যা মোকাবিলায় ঢালাওভাবে ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। খেলাপি নামের সমস্যা দূর করতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় গ্রহীতা ও দাতার ক্ষেত্রে একইভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে বলে মত খাত সংশ্লিষ্টদের।

অর্থসূচক/ মো. সুলাইমান

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.