সেমিফাইনালে জিতে ফাইনালের রাস্তা প্রশস্ত মোদীর

ভারতে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ভোট গণনায় বেসরকারি ফলে রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ এবং ছত্তিশগড়ে ক্ষমতায় আসতে চলেছে বিজেপি। অন্যদিকে, প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস তেলেঙ্গানায় ক্ষমতায় আসতে চলেছে। বাকি মিজোরাম রাজ্যের ফলও দ্রুতই জানা যাবে।

এদিকে দেশটির এই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনকে বলা হয় লোকসভার সেমিফাইনাল। কারণ, আর ঠিক ছয় মাস পরে লোকসভা নির্বাচন। তার আগে এই বিধানসভা নির্বাচন থেকে উত্তর ভারত, যাকে হিন্দি বলয় বা গোবলয় বলা হয়, সেখানকার ভোটাররা কী ভাবছেন, তা বোঝা যায়। দক্ষিণ ভারতের রাজ্য তেলেঙ্গানা ও উত্তরপূর্বের রাজ্য মিজোরামের ফলাফল তাৎপর্যবাহী। কারণ, সেখানে উত্তরপূর্ব ও দক্ষিণ ভারতের মতামতের কিছুটা প্রতিফলন হয়।

পাঁচবছর আগে উত্তর ভারতের তিন রাজ্য মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থানে কংগ্রেস জিতেছিল। তারপর নরেন্দ্র মোদী তার কৌশল বদল করেন। কৃষকেরা তার উপর ক্ষুব্ধ বুঝতে পেরে তাদের জন্য বছরে তিন কিস্তিতে ছয় হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণা করেন। গরিবদের বিনা পয়সার রেশন চলতে থাকে। করোনাকালে তার পরিধি আরো অনেক বাড়ে। একশ দিনের কাজ বন্ধ করে দেয়ার জায়গায় তা আরো বাড়ানো হয়। ফলে লোকসভায় এই সব রাজ্যের সিংহভাগ আসনে জয়লাভ করতে নরেন্দ্র মোদীর কোনো অসুবিধা হয়নি।

এইবার পাঁচ রাজ্যের মধ্যে তিন রাজ্য মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় এবং রাজস্থানে বিজেপি জিতেছে। কংগ্রেস জিতেছে মাত্র একটি রাজ্য তেলেঙ্গানায়। এর ফলে গোটা ভারতে কংগ্রেস একা কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা ও হিমাচল প্রদেশ মাত্র এই তিন রাজ্যে ক্ষমতায় রইলো। । বিহার ও ঝাড়খণ্ডে তারা ক্ষমতাসীন জোট ও সরকারে আছে। আর বিজেপি শাসনাধীন রাজ্যের সংখ্যা বেড়ে হলো ১২।

কিন্তু এই নিছক হিসাবের বাইরে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। তার প্রথমটিই হলো- গোবলয়ে কংগ্রেস আর কোনো রাজ্য়ে এককভাবে ক্ষমতায় থাকলো না। উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান সবই বিজেপি-র দখলে চলে গেল। এর মধ্যে উত্তরপ্রদেশে ৮০টি লোকসভার আসন আছে। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও উত্তরাখণ্ড মিলিয়ে আছে ৬৯টি আসন। পশ্চিম ভারতের যে তিন রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় সেই মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও গোয়ায় আছে ৭৬টি আসন। সবমিলিয়ে ২২৫টি আসন। লোকসভায় এই ২২৫টি আসনে নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপি-র প্রভাব সবচেয়ে বেশি।

পাঁচ রাজ্যের এই বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি কোনো ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রীকে পর্যন্ত সামনে রেখে ভোট করেনি। ভোট হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে সামনে রেখে। লোকসভা নির্বাচনের আগে নেয়া এই ঝুঁকি পুরোপুরি কাজে লেগে গেছে। উত্তর ভারতে মোদীর জনপ্রিয়তার যেমন আরো একবার যাচাই হয়ে গেছে, তেমনই কংগ্রেসকে আবার একটা বড় ধাক্কা দেয়া সম্ভব হয়েছে।

কর্ণাটক নির্বাচনে জেতার পর যে কংগ্রেস নেতারা সাফল্যের হাওয়ায় ভাসছিলেন, যারা অখিলেশের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও সমাজবাদী পার্টিকে মাত্র ছয়টি আসন ছেড়ে দিয়ে জোট করেননি, তারা আবার বাস্তবের কঠিন মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়লেন। কংগ্রেস নেতারা জানতেন, মধ্যপ্রদেশে যাদবদের চার শতাংশ ভোট আছে। তারপরেও কমলনাথের মতো দাম্ভিক রাজনীতিক সমাজবাদী নেতাকে ‘অখিলেশ-ফখিলেশ’ বলে তাচ্ছিল্য করেছিলেন। অখিলেশ তখনই বলেছিলেন, তিনি কংগ্রেসকে শিক্ষা দেবেন।

প্রায় একই অভিযোগ নীতীশ কুমারও তো করেছেন। কংগ্রেসের ঔদ্ধত্যের অভিযোগ, আঞ্চলিক দলগুলিকে প্রাপ্য সম্মান, গুরুত্ব ও আসন না ছাড়ার অভিযোগ। এবার সেই কংগ্রেস এমন চাপে পড়লো, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র সব জায়গায় শরিকেরা লোকসভার সময় হয় তাদেরও অনেক কম আসন ছাড়তে চাইবে বা আসন দেবেই না। একের বিরুদ্ধে একের লড়াইয়ের তত্ত্ব কংগ্রেসই তো বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিলো।

বুধবারই খাড়গে ইন্ডিয়া জোটের বৈঠক ডেকেছেন। সেই বৈঠকেই কংগ্রেসের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে বিরোধী দলগুলি। সাফল্য অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয়। আর ব্যর্থতা সবসময় ঘাড়ের উপর চেপে বসে। রাজনীতিতে এটাই দস্তুর। কংগ্রেস নেতারা বারবার ধাক্কা খেয়েও এটা শিখতে চান না।

এদিকে, কংগ্রেসের বিপর্যয় প্রসঙ্গে দলটির সিনিয়র নেতা আচার্য প্রমোদ কৃষ্ণমের বলেছেন, সনাতন ধর্মের বিরোধিতা দলকে ডুবিয়ে দিয়েছে। জাতিশুমারি ইস্যুতে তিনি বলেন, ভারত কখনই বর্ণভিত্তিক রাজনীতিকে মেনে নেয়নি। সনাতন ধর্মের বিরোধিতা করার জন্য কংগ্রেস অভিশপ্ত হয়েছে। এটা কংগ্রেসের পরাজয় নয়, এটা বামেদের পরাজয়।

পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বিজেপির জয়কে কংগ্রেসের ব্যর্থতা বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে বিজেপির জয় বিজেপির সাফল্য নয়, এটা কংগ্রেসের ব্যর্থতা। কংগ্রেসের যে দুর্বলতা, যে সাংগঠনিক ব্যর্থতার কথা আমরা বারবার বলছিলাম, এটা কংগ্রেসের সেই সাংগঠনিক দুর্বলতা ও ব্যর্থতা। বিজেপির জয় নয়, এটা কংগ্রেসের ব্যর্থতা’ বলে মন্তব্য করেছেন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ।

দক্ষিণ ভারতে লোকসভার আসনসংখ্যা হলো ১৩০টা। তার মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশের ২৫টি আসন প্রথমেই বাদ দেয়া দরকার। সেখানে কংগ্রেস কার্যত মুছে গেছে। তামিলনাড়ুর ৩৯টি আসনের মধ্যে কংগ্রেসের ভাগে নয়-দশটির বেশি পড়বে না। ফলে সেখান থেকেও ৩০টি বাদ। ৭৫টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস যদি অর্ধেকও জিততে পারে, তাহলে সংখ্যাটা হবে ৩৭-৩৮।

গোবলয়, পূর্ব ভারত, উত্তরপূর্বে কংগ্রেস কটা আসন পেতে পারে? এর মধ্যে একমাত্র বিহারে তারা জোট সরকারে আছে। আসামে গতবার কয়েকটি আসনে তারা জিতেছিল। পশ্চিমবঙ্গে বহরমপুরের বাইরে তো তাদের জেতা কঠিন। তাহলে হাতে তো সেই পেনসিলই থেকে যাচ্ছে।

এটাই এই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। এটাও দেখিয়ে দিচ্ছে, উত্তর ভারতে মোদীর জনপ্রিয়তা আগের মতোই অটুট। কিছুদিন আগেই আগে দেশটির কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, গরিব মানুষকে বিনা পয়সায় রেশন, অতি গরিবদের আরো বেশি পরিমাণ রেশন ২০২৯ সাল পর্যন্ত দেয়া হবে। কৃষকদের দেয়া সাহায্যও চলতে থাকবে। কংগ্রেস ভেবেছিল, জাতিগত জনগণনা ও ঢালাও জনমোহিনী প্রকল্পের লোভ দেখিয়ে তারা ভোটে জিতে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। বরং ভোটের মুখে মহাদেব বেটিং কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে ছত্তিশগড়ের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল চরম বেকায়দায় পড়েছেন।

মাস ছয়েক পরে লোকসভা নির্বাচনে যদি মোদী জিতে যান, তাহলে ভারতে নেহরুর পরপর তিনবার লোকসভা ভোটে জেতার রেকর্ড তিনি ছুঁয়ে ফেলবেন। বিজেপি নেতারা এখন সেই কথাটাই বলতে শুরু করে দিয়েছেন। খবর- ডিডাব্লিউ ও পার্সটুডে

অর্থসূচক/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.