গাজায় যুদ্ধবিরতি, ৫০ বন্দিকে মুক্তি দেবে হামাস

গাজায় সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে রাজি ইসরায়েল ও হামাস । এই সমঝোতা বুধবার ভোরে ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে।

৩৮ সদস্যবিশিষ্ট ইসরাইলি মন্ত্রিসভার উগ্র ডান-পন্থি ওৎজমা ইয়েহুদিত পার্টির তিন সদস্য এই চুক্তির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। ওই তিন মন্ত্রী এ চুক্তিকে তেল আবিবের জন্য ‘ভয়াবহ’ বলে মন্তব্য করেছেন।

চুক্তিতে বলা হয়েছে, ইসরাইলি কারাগারে আটক ১৫০ ফিলিস্তিনি নারী ও শিশু বন্দির মুক্তির বিনিময়ে হামাস তাদের হাতে আটক ৫০ ইসরাইলি নারী ও শিশুকে মুক্তি দেবে। সেইসঙ্গে চারদিন অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি পালিত হবে অর্থাৎ ইসরাইল বা প্রতিরোধ যোদ্ধারা কেউ কারো বিরুদ্ধে হামলা করবে না।

যেসব ইসরাইলি নারী ও শিশু মুক্তি পেতে যাচ্ছে তাদের মধ্যে ৩০টি শিশু, তাদের আটজনের আট মা এবং আরো ১২ নারী রয়েছেন। মার্কিন গণমাধ্যম বলেছে, এই ৫০ জনের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিন নাগরিক রয়েছে।

ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দপ্তর দাবি করেছে, এরপর হামাস প্রতি ১০ জন করে অতিরিক্ত বন্দিকে মুক্তি দিলে তার বিনিময়ে একদিন করে যুদ্ধবিরতি বাড়ানো হবে। তবে এর বিনিময়ে কোনো ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তি পাবে কিনা তা বলেনি ওই দপ্তর। ওই দপ্তর আরো দাবি করেছে, চুক্তি অনুযায়ী, এখনও যেসব ইসরাইলি বন্দি মুক্তি পায়নি তাদের সঙ্গে রেডক্রসের কর্মকর্তারা দেখা করতে পারবেন।

ইসরাইলি গণমাধ্যম হারেতজ বলেছে, মুক্তিপ্রাপ্ত নারী ও শিশুদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য ইসরাইলের ছয়টি হাসপাতালকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এসব হাসপাতালের অন্য রোগীদের সঙ্গে যাতে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিদের দেখা না হয় এবং গণমাধ্যম কর্মীরা যেন তাদের কাছে যেতে না পারে সেজন্য এসব নারী ও শিশুর জন্য হাসপাতালগুলোর মধ্যে আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বর্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, কাতার ও আমেরিকার কিছু মধ্যস্থতাকারী গোপনে এই সমঝোতা করার লক্ষ্য়ে কাজ করে গেছেন। তারা জানিয়েছেন, এই সমঝোতা অবিলম্বে চালু হবে।

ইসরায়েলের মিডিয়া জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার থেকে পণবন্দিদের মুক্তি দেয়া শুরু হবে।

এই সমঝোতা অনুমোদনের আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি মানে যুদ্ধ পুরোপুরি থেমে যাওয়া নয়। হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধ চলবে। যতদিন ইসরায়েলের সব লক্ষ্যপূরণ না হচ্ছে, ততদিন এই যুদ্ধ চালানো হবে।

নেচানিয়াহু বলেছেন, যতদিন হামাসকে নিশ্চিহ্ন না করতে পারছি, যতদিন সব পণবন্দি মুক্তি পাচ্ছে, যতদিন এটা না নিশ্চিত হচ্ছে যে গাজা থেকে আর কেউ ইসরায়েলের বিপদের কারণ হবে না, ততদিন য়ুদ্ধ চলবে। এই যুদ্ধবিরতির ফলে ইসরায়েলের সেনা যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতিও নিতে পারবে। নেতানিয়াহু এই সমঝোতার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনকেও ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

হামাস একটি বিবৃতিতে বলেছে, ‘আমরা যখন সমঝোতা চুক্তির কথা ঘোষণা করছি, তখন আমাদের আঙুল ট্রিগারে রয়েছে। আমাদের যোদ্ধারা আমাদের মানুষকে রক্ষা করার কাজ চালিয়ে যাবে।’

সাম্প্রতিক দিনগুলোতে গাজার স্থল যুদ্ধে ইসরাইলের বহু সেনা, ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়েছে এবং লেবাননের প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকেও ইসরাইলের উত্তর-সীমান্তে হামলা জোরদার হওয়ায় ইসরাইল বেশ বেসামাল অবস্থায় পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। হিজবুল্লাহ উত্তর ইসরাইলে এ পর্যন্ত অন্তত এক হাজার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর নিখুঁত হামলায় হতাহত হয়েছে ইসরাইলের বহু সেনা এবং বেশ কয়েটি ঘাঁটি ধ্বংস হয়েছে। কোনো কোনো ইসরাইলি ঘাঁটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। ওদিকে ইয়েমেনের আনসারুল্লাহও ইসরাইলের কোনো কোনো সামরিক অবস্থানে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। আনসারুল্লাহ ইসরাইলের জন্য রসদবাহী এক বিশাল জাহাজও আটক করেছে লোহিত সাগরে। ফলে ইসরাইল বেশ চাপের মুখে পড়েছে রণাঙ্গনে। মার্কিন সরকার ইসরাইলের প্রধান সহযোগী হওয়ায় ইরাক ও সিরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটিগুলোর ওপরও ক্রমেই হামলা বাড়ছে। ফলে মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকেও হয়তো ইসরাইলের ওপর চাপ ক্রমেই বাড়ছিল।

ইসরাইলের ভেতরেও যুদ্ধ-বিরতির জন্য নেতানিয়াহুর ওপর চাপ ক্রমেই বাড়ছে। ইসরাইলে হামাসের অতর্কিত হামলার পর ইসরাইলি সেনাবাহিনীর ভুল ও দিশাহারা পদক্ষেপের কারণে প্রায় সাড়ে তিনশত ইসরাইলি নাগরিক নিহত হওয়ার খবর ফাঁস হওয়ায়ও ঘরোয়াভাবে ব্যাপক চাপের শিকার হয়েছে নেতানিয়াহুর সরকার। হামাসকে দুর্বল করা বা ধ্বংস করতে এবং ইসরাইলি যুদ্ধ-বন্দিদের মুক্ত করার জন্য স্থল-অভিযান ও বোমা হামলা কার্যকর বলে প্রমাণ হয়নি। অন্য কথায় ইসরাইল হামাসের তেমন কোনো ক্ষতিই করতে পারেনি ৪৬ দিন ধরে অভিযান চালিয়েও। অথচ গাজার বেসামরিক জনগণের ওপর ও বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ওপর ইসরাইলের পাশবিক গণহত্যা আর অমানবিক অবরোধ অব্যাহত থাকায় বিশ্ব-জনমত এবং বিশ্বের অনেক সরকার ইসরাইলের ওপর চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিবাদ জোরদারের মাধ্যমে।

বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশ ইসরাইলের যুদ্ধ অপরাধের বিষয়টি তদন্ত করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন জানিয়েছে। বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা বা মন্ত্রী যুদ্ধ-অপরাধের জন্য প্রকাশ্যে ইসরাইলের নিন্দা জানিয়েছে এবং কোনো কোনো দেশ ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন অথবা স্থগিত করেছে। সূত্র: ডিডাব্লিউ, পার্সটুডে, এপি, এএফপি, রয়টার্স

অর্থসূচক/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.