পোশাক শিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে চাই সময়োপযোগী উদ্যোগ

রপ্তানি খাতে তৈরি পোশাকের প্রভাব নিরঙ্কুশ। এই খাতকে ঘিরেই অর্থনীতিতে এখন প্রাণপ্রবাহ। ব্যাংক, বীমা, কি কর্মসংস্থান, অর্থনীতিতে নারীর ক্ষমতায়ন– সব খাতেই মূল্য সংযোজন করছে  পোশাক খাত।  অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক নানামুখী সমস্যা রয়েছে এখাতে। তবে সম্ভাবনা রয়েছে তার চেয়েও বেশি। বিশেষশত, ভূরাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট সম্ভাবনাটা এ শিল্পকে নতুন দিশা দিতে পারে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শীতল সম্পর্ক বিরাজমান। এর ফলে মার্কিন ক্রেতারা এখন চীনের বিকল্প খুঁজছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশই তাদের হাতে সবচেয়ে ভালো বিকল্প। চীন মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের ফল হিসেবেও  অনেক মার্কিন ব্র্যান্ড এবং ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে পোশাক নেওয়ার  আগ্রহ প্রকাশ করেছে–যারা এতদিন চীননির্ভর ছিল।

সম্প্রতি প্রকাশিত ইউনাইটেড স্টেটস ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বেঞ্চ স্টাডি ২০২৩ অনুযায়ী মার্কিন ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলি আগামীতে বাংলাদেশ থেকে সোর্সিং বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। আবার চীন পোশাক শিল্পের চেয়ে অন্যান্য শিল্প খাতে  বেশি মনযোগী হয়ে উঠছে। এতে পোশাক দুনিয়ায় দুর্বার গতি দিয়েছে  বাংলাদেশকে। এই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য আমাদেরকে কয়েকটি বিষয় খেয়াল করা প্রয়োজন। পণ্যের বৈচিত্র্য, উদ্ভাবনী ও ম্যান মেইড ফাইবার বা কৃত্রিম তন্তুর পোশাকে  মনোযোগ এবং বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। চার দশকের যাত্রায়  পোশাক শিল্প বহদূর এগিয়েছে, রপ্তানিতে দ্বিতীয় স্থানও আমাদের দখলে।

তবে এই দীর্ঘ সময় আমাদের পোশাক শিল্পে পণ্যের উপকরণ বহুমুখীকরণ তেমন একটি হয়নি।  রপ্তানি মোটামুটি ৫টি ক্যাটাগরি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশই হল শার্ট, টি-শার্ট, ট্রাউজার, জ্যাকেট এবং সোয়েটার যার বেশিরভাগ হচ্ছে কটন পণ্য। যেখানে বিশ্বে  মোট টেক্সটাইল ব্যবহারের প্রায় ৭৫ শতাংশ, নন-কটন এবং সেখানে আমাদের কটনের শেয়ার মাত্র ২৫ শতাংশ, বর্তমানে বৈশ্বিক পোশাক বাণিজ্যের ৫২ শতাংশ পণ্য নন-কটনের, সেখানে আমাদের নন-কটন পোশাকের রপ্তানির মাত্র ২৭ শতাংশ। বিশ্বজুড়ে পোশাকের ভোক্তারা কটন বা সুতির পোশাকের পরিবর্তে ধীরে ধীরে ম্যান মেইড ফাইবারের পোশাক ক্রয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে। অথচ আমাদের সুতির পোশাক উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

এটি স্পষ্ট যে, ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বিশ্ব বাজারের প্রবণতা ও চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য বজায় রেখে আমাদের পণ্যের বৈচিত্র্যকরণের দিকে অর্থাৎ নন কটন বা কৃত্রিম তন্তু পণ্য উৎপাদনে বিশেষ গুরত্ব দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আউটারওয়্যারে আমাদের জন্য বিশেষ সম্ভমনাময়।

ইউরোপ এবং আমেরিকা আমাদের পোশাক রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার। আর ইউরোপ এবং আমেরিকা মূলত শীত প্রধান দেশ যেখানে বছরের বেশিরভাগ সময় শীত থাকার কারণে শীতের পোশাকের অর্থাৎ জ্যাকেট বা আউটার ওয়্যারের বাপক চাহিদা রয়েছে। এই আউটার ওয়্যারের চাহিদার সিংহভাগ চীন রপ্তানি করে থাকে। যেহেতু আগেই বলেছি মার্কিন ক্রেতাগণ চীনের বিকল্প হিসাবে বাংলাদেশকে বিবেচনা করছে, কাজেই এই সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে পারি।

তাছাড়া শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘনের উল্লেখ পশ্চিমা পোশাক পোশাক ব্র্যান্ডসমূহ মিয়ানমারের পোশাক কারখানা থেকে তাদের পণ্য সরবরাহ বন্ধ করার সিন্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে এই সকল ক্রেতা পোশাক ক্রয়ের মিয়ানমারের বিকল্প খুঁজছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হতে পারে তাদের পছন্দনীয় বিকল্প। মিয়ানমারও আউটার ওয়্যার তৈরি ও রপ্তানি করে থাকে। কাজেই এটি আমাদের শিল্পের জন্য একটি বিশাল সুযোগ।

বাংলাদেশ থেকে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে আউটার ওয়্যার রপ্তানির পরিমাণ ছিলো প্রায় ২ দশিমক ১ বিলিয়ন ডলার। যেখানে ২০২২ সালে বিশ্বে আউটার ওয়্যার রপ্তানি বাজারের পরিমাণ প্রায় ৩৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।কাজেই এটি স্পষ্ট যে আউটারওয়্যারে আমাদের বিশাল সুযোগ রয়েছে। আমাদের দেশে এক সময় বিশেষ করে ২০০৫ সালের পূর্বে যখন ‘কোটা সুবিধা’ ছিল, তখন বাংলাদেশে অনেকেই আউটারওয়্যার তৈরি ও রপ্তানি করতো। সে ক্ষত্রে বলা যায় আমাদের শিল্পের আউটার ওয়্যার তৈরি করার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা রয়েছে। সেদিক বিবেচনায় পোশাকের এই ক্যাটাগরিতে ভালো করা ও সুযোগ কাজে লাগানোর সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে।

আউটারওয়্যারে আমাদের ভালো করতে হলে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। আউটারওয়্যার একটি নন-কটন পণ্য অর্থাৎ এই ধরেনের পণ্য উৎপাদনে ম্যানমেইড ফাইবার প্রয়োজন। ম্যানমেইড ফাইবারের জোগানের জন্য আমাদেরকে চীনের উপর নির্ভর করতে হয়। আউটারওয়্যারে ভালো করতে হলে আউটারওয়্যার তৈরিতে প্রয়জনীয় কাপড় ও অন্যান্য কাঁচামাল যদি বাংলাদেশ থেকে পাওয়া যায় তবে তা দামে সাশ্রয়ী হবে ও সময় বাঁচবে। সেক্ষেত্রে লিড টাইম কমে যাবে যা প্রতিযোগী সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

ম্যানমেইড ফাইবার উৎপাদনের জন্য আমাদের টেক্সটাইল তথা বস্ত্র খাতে বিনিয়োগ প্রয়োজন। পাশাপাশি এ ধরনের শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়জনীয় অবকাঠামো ও জ্বালানি নিরাপত্তা দরকার। এ খাতে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে প্রণোদনা দেয়ার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পণ্য বৈচিত্রকরণের কোনো বিকল্প নেই। মূল্য সংযোজন ও উচ্চ মূল্যের পোশাক তৈরি ও রপ্তানির দিকে আমাদেরকে অগ্রসর হতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে হলে আমাদের শিল্পের সামনে যে সম্ভাবনা ও সুযোগ রয়েছে তা কাজে লাগাতে হবে। পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাগণকে সময়পোযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

পাশাপাশি আমাদের পোশাক শিল্প যাতে তার সুযোগসমূহ কাজে লাগাতে পারে তার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি ও নীতি সহায়তা প্রদানে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সক্ষমতাও আমাদের আছে। বিশ্ব পোশাক রপ্তনির বাজারে আমাদের অংশও বেড়েছে। ২০২১ সালে বৈশ্বিক রপ্তানিতে অংশ ছিল ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। গত বছর সেই অংশ বেড়ে ৭ দশিমক ৯০ শতাংশে  দাঁড়িয়েছে।

পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে। তৈরি পোশাক রপ্তানির দিক যদিও বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে, তবে প্রথম স্থানে থাকা চীনের সাথে এ ব্যবধান বিশাল। বিশ্ববাজারে ২০২২ সালে পোশাক রপ্তানিতে চীনের অংশ ছিল ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ।

লেখক # আশিকুর রহমান (তুহিন)

ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ট্যাড গ্রুপ

সাবেক পরিচালক, বিজিএমইএ

 

 

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.