ডলার সংকটের নেপথ্যে দুর্নীতি ও টাকা পাচার

করোনা সংকট কাটিয়ে দেশের অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিলো। তবে এরপরেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এতেই দেশের অর্থনীতিতে টালমাটাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এরই মধ্যেই আবার শুরু হয়েছে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ। বিভিন্ন দেশের যুদ্ধ শীঘ্রই শেষ হবে বলে হচ্ছে না।

প্রায় দুই বছর ধরে দেশে ডলার সংকট চলছে। এই সংকট সমাধানে নানা উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। সরকারের বিদেশি কেনাকাটার দায়ও পরিশোধ করা হচ্ছে। এর ফলে রিজার্ভে ধারাবাহিক পতন অব্যাহত রয়েছে।

এদিকে দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচারের কারণে ডলার সংকট দেখা দিয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে ও প্রবাসী আয় কমে যাচ্ছে। এছাড়া অস্বাভাবিক মুনাফা লাভের আশায় ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত ডলার কিনে মজুদ করে রাখছেন। এর ফলে ডলার সংকট আরও প্রকট আকার ধারন করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন অর্থসূচককে বলেন, অর্থপাচার একটি বড় সমস্যা। এটি ডলার সংকটের জন্য অনেকটা দায়ী। তাই অর্থপাচার কিভাবে কমানো যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। কারা এই কাজটি করছে ও কিভাবে করছে সেটি বের করতে হবে। কারণ মূল যায়গায় আঘাত করতে না পারলে অর্থ পাচার বন্ধ করা সম্ভব না।

তিনি আরও বলেন, সংকট ঠিক করতে হলে ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করতে হবে। কারণ নির্ধারিত ডলারের দাম সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। উল্টো ডলার মজুদের মতো বিষয়গুলোকে উৎসাহিত করছে। এর ফলে সংকট আরও বাড়ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলা হয়েছে নির্বাচনের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। এরকম কথা আমরা আগেও অনেক শুনেছি। তবে কোন কিছুই ঠিক হয়নি।

এদিকে অর্থ পাচারের ভংকর আকারের কথা নিজেই স্বীকার করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি বলেন, অর্থ পাচার খুবই খারাপ আকার ধারণ করেছিল। বিশেষ করে ট্রেড বেজড মানি লন্ডারিং। হুন্ডির চেয়ে অন্ততপক্ষে ১০ গুণ টাকা পাচার হয়েছে ওভার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে। একশো ডলারের দামের পণ্য ৩০০ ডলারের এলসি করা হয়েছে। এভাবে দেশ থেকে টাকা পাচার করে নিয়ে গেছে।

গভর্নর বলেন, দুবাইতে ১৩ হাজার বাংলাদেশি মালিকানাধীন কোম্পানি আছে। একেকটা কোম্পানি করতে কমপক্ষে ৫ কোটি টাকা লেগেছে। এই টাকা বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে দুবাইতে গেছে। পর্তুগালে গত দুই বছরে ২ হাজার ৫০০ বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নিয়েছে। তাদের প্রত্যেককে কমপক্ষে ৫ লাখ ইউরো ইনভেস্ট করতে হয়েছে। এই টাকাও এই দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে বলে জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, এলসি ওপেনিংয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন রেস্ট্রিকশন নেই। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শুধু সরকারের আমদানি ব্যয় মেটাতে ডলার সাপোর্ট দেওয়া হবে। বেসরকারি খাতের আমদানি ব্যয় ব্যাংকগুলোর নিজস্ব ডলার ইনফ্লো থেকে মেটাতে হবে। এখন ব্যাংকগুলো সে কাজটা করছে। গতমাসে রেমিটেন্স বেশি আসায় এলসি খোলাও বেড়েছে।

প্রায় দুই বছর ধরে ব্যাংকগুলোকে ডলার সাপোর্ট দিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে রিজার্ভ এখন তলানিতে নেমেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসের শুরুতে নিট রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৪৭৫ কোটি ডলার। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯৪৫ কোটি ডলারে। আর জুলাইয়ের শুরুতে গ্রস রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ১২০ কোটি ডলার। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪২ কোটি ডলারে। গ্রস হিসাবে আলোচ্য সময়ে রিজার্ভ কমেছে ৪৭৮ কোটি ডলার।

এদিকে কমতে থাকা রিজার্ভ থেকে আর কোন খাতে বিনিয়োগ করবেন না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। তিনি বলেন, এখন থেকে রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে দেশের অভ্যন্তরে আর ডলার বিনিয়োগ করা হবে না। যেসব খাতে রিজার্ভ বিনিয়োগ করা হয় তাও কমিয়ে আনা হবে। ইতিমধ্যে সাড়ে ৭ বিলিয়নের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) সাড়ে তিন বিলিয়ন করা হয়েছে। পায়রা বন্দরের ঋণ আদায়ে চেষ্টা করা হচ্ছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে নতুন ডলার আসবে। তখন রিজার্ভ বাড়বে। এজন্য দেশের রিজার্ভ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।

অস্বাভাবিক মুনাফা লাভের আশায় অনেক ব্যবসায়ী অতিরিক্ত ডলার মজুদ করে রাখছে। প্রতিদিন টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় মূল্যে হচ্ছে নতুন নতুন রেকর্ড। খোলাবাজারে ডলারের দাম এরই মধ্যে ১২১ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আর সংকট কাটাতে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে ১২২ থেকে ১২৪ টাকায় ডলার কিনছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে সবচেয়ে বেশি দরে ডলার কেনা হচ্ছে।

 

অর্থসূচক/সুলাইমান

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.