নানা কারণে ব্যাপক আলোচনায় থাকা সাবেক সেনা কর্মকর্তা চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীর গ্রেপ্তার হয়েছেন। আজ মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক এই লেফটেন্যান্ট জেনারেলকে গ্রেফতার করেছে। য়া আরেফী নামে আমেরিকার পাসপোর্টধারী এক ব্যক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভুয়া উপদেষ্টা সাজিয়ে বিএনপি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত এক মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গত শনিবার বিএনপির মহাসমাবেশ ভণ্ডুল হয়ে যাওয়ার কিছু সময় পর তিনি মিয়া আরেফীকে নিয়ে বিএনপি কার্যালয়ে যান। মিয়া আরেফী বিএনপি নেতা-কর্মী ও সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘‘র্যাবকে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিতে সহায়তা করেছি৷ এখন পুলিশ ও আনসার বাহিনীকেও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনার পরামর্শ দেবো৷ পাশাপাশি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীকেও এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে৷ মার্কিন সরকার বিএনপির সঙ্গে আছে।” এ সময় তার পাশে লে. জেনারেল (অব.) চৌধুরী হাসান সোরাওয়ার্দী ও ইশরাক হোসেনসহ বেশ কয়েকজনকে দেখা যায়৷
বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এক বিবৃতিতে জানায়, নিজেকে জো বাইডেনের উপদেষ্টা হিসেবে মিয়া আরেফী যে দাবি করেছেন, তা সত্য নয়। আর তখন থেকেই মিয়া আরেফির পাশাপাশি হাসান সারওয়ার্দীকেও নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলতে থাকে।
রোববার মিয়া আরেফী যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলে বিমানবন্দর থেকে ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। সেদিন রাতেই মহিউদ্দিন শিকদার নামের একজন ব্যক্তি মিয়া আরেফী, চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী ও বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে আসামি করে পল্টন থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়।
এদিকে আজ (৩১ অক্টোবর) প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তিনি ইতোমধ্যে সেনা কর্মকর্তা চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন। তার কিছুক্ষণ পরেই তার গ্রেপ্তারের খবর জানা যায়।
চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী দীর্ঘদিন ধরেই নানা কারণে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আছেন। এর আগেও তিনি বেশ কয়েকবার আলোচনায় এসেছিলেন। ২০১৩ সালে ‘রানা প্লাজা’ ধসে পড়ার ১৭ দিন পর রেশমা বেগমকে জীবিত উদ্ধারের ঘটনা সারা দুনিয়ার গণমাধ্যমে আলোড়ন তুলেছিল। এই উদ্ধার তৎপরতার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। রেশমা বেগমকে ১৭দিন পর ধ্বংসস্তূপের নিচে থেকে উদ্ধারের ঘটনাকে ‘সাজানো নাটক’ বলে যুক্তরাজ্য ডেইলি মিররসহ অনেক বিদেশি মিডিয়াতে সংবাদ প্রকাশ হয়েছিলো।
‘রানা প্লাজা’ ধসের উদ্ধার অভিযানের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন তখনকার সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের তৎকালীন অধিনায়ক মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী। তার বিরুদ্ধেই মূলত ওই ‘সাজানো নাটক’ এর অভিযোগ ওঠে। তবে তখন ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা কয়েকটি দেশি-বিদেশি সংবাদপত্রে ‘সাজানো নাটক’ নিয়ে যেসব খবর বেরিয়েছে সেগুলোকে ‘সর্বৈব মিথ্যে’ বলে উল্লেখ করেন।
অভিযোগের বিষয়ে তিনি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, “ব্রিটেনের ডেইলি মিররে যা ছাপা হয়েছে, তাকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বলা যায় না। এটিকে অনুসন্ধানী রিপোর্ট তখনই বলা যাবে, যখন উভয় পক্ষের বক্তব্য নেয়া হবে এবং একটা কনক্লুসিভ স্টেটমেন্ট থাকবে। ঐ পত্রিকায় যে রিপোর্টটি এসেছে, সেটি বাংলাদেশের একটি অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের হুবহু ইংরেজী সংস্করণ। তাতে বোঝা যায় সাইমন রাইট বাংলাদেশে এসে কোন ইনভেস্টিগেশন করেননি।”
তিনি আরও বলেছিলেন, রেশমা বেগমকে উদ্ধারের ঘটনা নিয়ে যদি কারও কোন সন্দেহ থাকে, তাদেরই উচিৎ সেটা প্রমাণ করা। নাম প্রকাশ না করে একজনকে উদ্ধৃত করে তারা যেটা ছেপেছে, তাকে অনুসন্ধানী রিপোর্ট বলা যায় না।”
এছাড়া ২০২০ সালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী তার প্রথম স্ত্রী ফারজানা নিগারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। সেনাবাহিনীর নাম ব্যবহার করে হুমকি দেওয়ার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ওই মামলা করেছিলেন।
সেই সময়ে মামলার অভিযোগ থেকে জানা গিয়েছিলো, ফারজানা নিগার চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীর প্রথম স্ত্রী ছিলেন। বাদীর সঙ্গে তার বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও তিনি বাদীকে নানাভাবে হয়রানি করেন। সবশেষ গত ৮ অক্টোবর আসামি মোবাইলে একটি এসএমএসে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ থাকার কথা বলে বাদী ও তার পরিবারের সদস্যদের হুমকি দেন। এ ছাড়া বাদীর দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে অশালীন গালিগালাজ করেন।
তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে, তিনি সেনা পোশাক গায়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন।
নানা ‘বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে’র অভিযোগে ২০১৯ সালের এপ্রিলে তাকে সেনানিবাস ও সেনানিবাস আওতাভুক্ত এলাকায় অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়। একই বছরের ১৯ জুলাই খোদ আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানায়।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা, তিনি লে. জেনারেল পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর এনডিসির কমান্ড্যান্ট থাকাবস্থায় একাধিক নারীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তিনি এনডিসিতে পরিচালিত বিভিন্ন কোর্সের সঙ্গে বিদেশে ভ্রমণকালেও অনেক মেয়েকে নিয়ে চলাফেরা করেন এবং বিভিন্ন মাধ্যমে তার এই অশোভনীয় আচরণ এবং মেলামেশার ছবি কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত হলে কর্তৃপক্ষ বিব্রত হয় এবং তাকে বিভিন্নভাবে উপদেশ দেওয়া হয়। তিনি এলপিআর এ থাকাকালীন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ২০১৮ সালের ১৬ আগস্ট প্রথম স্ত্রীকে তালাক দেন এবং সেনা আইন বর্হিভূতভাবে মেসকিট (সামরিক পোষাক) পরে একই বছরের ২১ নভেম্বর কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিত দ্বিতীয় বিয়ে করেন।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, হাসান সারওয়ার্দীর এ ধরনের আচরণ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের জন্য অস্বস্তিকর ও বিব্রতকর। এ ধরনের ঘটনা সেনাবাহিনীতে কর্মরত অফিসার এবং অন্যান্য পদবীর মধ্যে নেতিবাচক উদাহরণ হিসেবে কাজ করে ও বিরুপ প্রভাব ফেলে। সামগ্রিক বিবেচনায়, গত বছরের ১০ এপ্রিল উক্ত অফিসারকে সেনানিবাস ও সেনানিবাস আওতাভুক্ত এলাকায় অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হয়।
উল্লেখ্য, সেনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ‘অবাঞ্চিত ব্যক্তি’র জন্য সেনানিবাস ও সেনানিবাসের আওতাভুক্ত সব স্থাপনা এবং সেনানিবাসের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা যেমন: সিএমএইচ এ চিকিৎসা সেবা, অফিসার্স ক্লাব, সিএসডি শপ ইত্যাদিতে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ।
২০২০ সালে চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থপাচারের অভিযোগ উঠেছিলো। একই বছরের শেষের দিকে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্তে নেমেছিলো।
লে. জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী (অব:) একজন খেতাবধারী সেনা কর্মকর্তা। চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে অসীম সাহস, ত্যাগ ও বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে ‘বীরবিক্রম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীর জন্ম চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে, ১৯৬০ সালে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ১৯৮০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দ্বিতীয় বিএমএ লং কোর্সের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, প্রতিরক্ষা বিজ্ঞান, ব্যবসা প্রশাসনে মাস্টার্স, এলএলবি ডিগ্রি এবং জাতীয় উন্নয়ন ও নিরাপত্তা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। তিনি ২০১৮ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
চৌকষ এই সেনা কর্মকর্তা দেশবিদেশে পরিচিত হন মূলত তার অবসরের পর তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং সরকারকে নিয়ে নানা সমালোচনা শুরু করার পর। নানা পত্রপত্রিকার খবর অনুসারে, ২০১৮ তে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হকের চাকরির মেয়াদ শেষ হলে পরবর্তী সেনাপ্রধান হিসেবে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান প্রার্থী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জেনারেল আজিজ আহমেদকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করে সরকার।
বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই মূলত জেনারেল আজিজ (অব) ও সরকারের সঙ্গে তার সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে চাকরিকালীন সময়ে এর কোনো বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। কিন্তু সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি বিভিন্ন সময়ে জেনারেল (অব:) আজিজ ও সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। এমনকি ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তিনি নানা প্রশ্ন তুলেন। অনেকে মনে করেন, সেনা প্রধানের পদ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভ থেকে জেনারেল আজিজ ও সরকারের এমন সমালোচনা করছেন। তবে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারসহ বিভিন্ন সময়ে তিনি এ অভিযোগকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
তৎকালীন সেনা প্রধান জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে করা নানা সমালোচনার প্রেক্ষিতে তার নির্দেশে লে. জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীর বিরুদ্ধে নানা ব্যবস্থা ও প্রচারনা চালানো হয় বলে তিনি বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করেছেন।
তবে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ যা-ই থাকুক না কেন, জেনারেল আজিজ (অব) ও সরকারের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিষয়টি পরবর্তী নানা ঘটনাপ্রবাহে থাকতে পারে বলে ওয়াকিবহালদের বিশ্বাস।
অর্থসূচক/



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.