বিনিয়োগে বড় ঝুঁকি তবুও দাম বাড়ছে বিটকয়েনের

একমাসে বেড়েছে ২৬ শতাংশ

বাংলাদেশসহ অনেক দেশে বিটকয়েন নিষিদ্ধ। এর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই, নেই লেনদেনের কোনো গ্যারান্টি। এছড়াা নিয়ন্ত্রণের জন্য নেই কোনো কর্তৃপক্ষ। এরপরও ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েনের চাহিদা এখন তুঙ্গে। হু-হু করে বাড়ছে বিটকয়েনের দাম। গত এক মাসে দাম বেড়েছে ৯ হাজার ডলার বা প্রায় ২৬ শতাংশ।

ডিজিটাল মুদ্রা লেনদেনকারী এক্সচেঞ্জ অ্যাপ বাইন্যান্স সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

তথ্য অনুযায়ী, এক মাস আগে অর্থাৎ ২৪ সেপ্টেম্বর একটি বিটকয়েন কিনতে খরচ করতে হতো ২৬ হাজার ডলার। আজ সকালে প্রতি বিটকয়েনের দাম বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩৫ হাজার ডলারে। গত ১৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ দর এটি। একদিন আগেও একটি ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েনের দাম ছিলো ৩০ হাজার ৫০০ ডলার। অর্থাৎ একদিনে দাম বেড়েছে ৪ হাজার ৫০০ ডলার।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশে বিটকয়েন কেনাবেচা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তারপরও থেমে নেই এর লেনদেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এর ব্যবসা বেআইনিভাবে বাংলাদেশেও প্রসারিত হচ্ছে। আবার প্রতারণার ঘটনাও ঘটছে। বিদেশে কেনা পণ্যের দাম যেমন বিটকয়েনের মাধ্যমে পরিশোধ করা হচ্ছে, তেমনি এতে বিনিয়োগ করাও হচ্ছে। আবার আন্তর্জাতিক লেনদেনেও এর ব্যবহার বাড়ছে।

ডিজিটাল বিটকয়েনের দাপটে অন্যান্য মুদ্রার দামও বাড়ছে। এক মাসের ব্যবধানে বিএনবির দাম বেড়েছে ২৬ ডলার। ২৪ সেপ্টেম্বর একটি বিএনবি কয়েনের দাম ছিল ২১০ ডলার। আজ এটির দাম উঠেছিল ২৩৬ ডলারে। আর একদিনে বিএনবির দাম বেড়েছে ১১ ডলার বা ৫ শতাংশ।

এছাড়া এই সময়ের মধ্যে আরেক কয়েন ইথেরিয়ামের দাম বেড়েছে ২০০ ডলার। এক মাস আগে এই ডিজিটাল মুদ্রাটির দাম ছিল ১ হাজার ৬০০ ডলার। আজ এটির দাম বেড়ে হয়েছিল ১ হাজার ৮০০ ডলার। একদিনে ইথেরিয়ামের দাম বেড়েছে ১৩৯ কোটি ডলার বা প্রায় ৮ শতাংশ।

জানা গেছে, বেআইনি এই মুদ্রা নিয়ে ব্যবসা করার দায়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে পুলিশ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। যারা এই অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এধরনের লেনদেন রোধে কাজ করে যাচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী ক্রিপ্টোকারেন্সির বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৩১ ট্রিলিয়ন ডলার। গত একদিনে বাজার মূলধনের উত্থান হয়েছে ৯ দশমিক ২২ শতাংশ। বাজার মূলধনের ৬৭ হাজার ১৯০ কোটি ডলার ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েনের দখলে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৫ হাজার ২৩০ কোটি ডলারের বিটকয়েন লেনদেন হয়েছে।

এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে ব্যাপকহারে বিটকয়েনের লেনদেন চলছে। ভারতেও এর ব্যবসার পরিধি বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ অনেক দেশে এ মুদ্রার মাধ্যমে যাতে কোনো প্রতারণার ঘটনা না ঘটে সে বিষয়ে মানি লন্ডারিং কর্তৃপক্ষ সতর্ক রয়েছে। চীনও তাদের দেশে ব্যক্তিগত কারেন্সি হিসাবে বিকল্প ভার্চুয়াল মুদ্রা বাজারে ছেড়েছে। বিটকয়েনের সঙ্গে পাল্লা দিতে অনেক দেশ ডিজিটাল মুদ্রার প্রচলন করেছে। এর মধ্যে চীন বেশি এগিয়েছে। তারা ডিজিটাল মুদ্রায় দেশের ভেতরে লেনদেন করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও লেনদেন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এদিকে জার্মানিতে বিটকয়েন ‘ব্যক্তিগত মুদ্রা’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইউরোপের অনেক দেশে অনলাইন লেনদেনে ব্যবহৃত হচ্ছে বিটকয়েন। পাশাপাশি সঞ্চয়ের উপকরণ হিসাবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে কালো টাকা বিনিয়োগ করতে ব্যবহৃত হচ্ছে বিটকয়েন। এর মূল্য অনেক বেশি এবং দাম বাড়ার কারণে বিনিয়োগকারীরা এ থেকে অতি দ্রুত ভালো মুনাফা পাচ্ছেন। এ কারণে অনেক দেশে বিটকয়েন বিনিয়োগে পরামর্শ দিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ, নেপাল, ইকুইয়েডর, বলিভিয়া, আলজিরিয়াসহ অনেক দেশে এর লেনদেন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তার পরও এসব দেশে অনলাইনে এ মুদ্রার লেনদেন হচ্ছে।

বাংলাদেশে বিটকয়েনের লেনদেন শুরু হয় ২০১২ সালের দিকে। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে এলে কিছু তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করে। এর ভিত্তিতে ২০১৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক এক গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।

তখন গণবিজ্ঞপ্তি বলা হয়, গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, দেশে বিটকয়েন নামীয় অনলাইনভিত্তিক কৃত্রিম মুদ্রা লেনদেন হচ্ছে। কিন্তু বিটকয়েন কোনো দেশের বৈধ কোনো মুদ্রা নয়। বিটকয়েন বা বিটকয়েনের মতো বা অন্য কোনো কৃত্রিম মুদ্রায় লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংক বা বাংলাদেশ সরকারের কোনো সংস্থা দ্বারা স্বীকৃত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনবহির্ভূত এসব লেনদেন বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৪৭ এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ১০১২-এর আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবে। সম্ভাব্য আর্থিক ও আইনগত ঝুঁকি এড়ানোর লক্ষ্যে বিটকয়েনের মতো কৃত্রিম মুদ্রায় লেনদেন বা এসব লেনদেনে সহায়তা প্রদান ও এর প্রচার থেকে বিরত থাকার জন্য সর্বসাধারণকে অনুরোধ করা যাচ্ছে।

এরপর থেকে বিটকয়েন বা অন্যান্য ডিজিটাল মুদ্রায় লেনদেন ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বার বার সতর্কতা জারি করা হচ্ছে।

২০০৯ সাল থেকে বিটকয়েন লেনদেন শুরুর পর এর দামে ব্যাপক ওঠানামা করেছে। তবে গড়ে এর দাম বেড়ে আকাশচুম্বী হয়েছে। ২০১৩ সালে প্রতিটি বিটকয়েনের দাম ছিল ৯৯ ডলার, ২০১৪ সালে তা বেড়ে ৯৫১ ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৫ সালে এর দাম কমে ২৫০ ডলারে নেমে যায়। ওই বছরে কয়েকজন গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে হ্যাকাররা কয়েন চুরি করলে এর দরপতন ঘটে। এরপর ২০১৬ সাল থেকে এর দাম আবার বাড়তে থাকে। ওই বছরে প্রতিটির দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৪০২ ডলার। ২০১৭ সালে আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৯১৮ ডলারে। ২০১৮ সালে এর দাম লাফিয়ে বেড়ে ১০ হাজার ৭৬০ ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৯ সালে আবার বড় ধরনের দরপতনের মুখে পড়ে মুদ্রাটি। ওই বছরে এক লাফে কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৫৩৬ ডলারে। ২০২০ সালে আবার বেড়ে ওঠে ৮ হাজার ৯০০ ডলারে।

এরপর ২০২১ সালে বিটকয়েনের দাম সর্বোচ্চ ৬৮ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর বিশ্বে করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ব্যাপকহারে দরপতন হতে থাকে এই মুদ্রাটির। চলতি বছরের শুরুতে মুদ্রাটির দাম কমে ১৫ হাজার ডলারের ঘরে নেমেছিলো।

অর্থসূচক/এমএইচ

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.