ফিলিস্তিনের ফিনিক্স পাখি দেফ এর নির্দেশে ইসরাইলে হামলা

গ্রিক পুরাণসহ বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীতে বর্ণিত এক অলৌকিক পাখির নাম ‘ফিনিক্স‘। এ পাখির মৃত্যু নেই। নেই বিনাশ। এর গায়ে আগুন দেওয়া হলে পুড়ে যাওয়া ছাই থেকে আবার জন্ম নেয়। বার বার তার পুনর্জন্ম হয়। এমনই এক ফিনিক্স পাখির নির্দেশে শনিবার পরাক্রমশালী ইসরাইলে হামলা চালিয়ে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সদস্যরা। তাদের হামলায় ৭শ ইসরাইলি নিহত হয়েছেন। তাদের এমন সুপরিকল্পিত হামলায় কাঁপন ধরে গেছে ইসরাইলিদের বুকে। চমকে উঠেছে পুরো বিশ্ব।

এই ফিনিক্স পাখির নাম মোহাম্মদ দেফ। তিনি হামাসের সামরিক শাখা ‘ইজেদিন আল-কাসাম ব্রিগেড’ এর প্রধান। ইসরাইলি গোয়েন্দারা বছরের পর বছর ধরে তাকে খুঁজে ফিরছে। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ইসরাইয়েলের সেনারা নয় থেকে দশবার হামলা চালিয়েছে। তাদের হামলায় একটি চোখ হারিয়েছেন দেফ। উড়ে গেছে শরীরের একাধিক অঙ্গ। তবু তাকে দমানো যায়নি। চোখ হারিয়েছেন বটে, কিন্তু হারায়নি বুকে লালন করা স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন। শরীরের একাধিক অঙ্গহানি কমাতে পারেনি তার ক্ষিপ্রতা।

মোহাম্মদ দেফের প্রকৃত নাম মোহাম্মদ ডিয়াব ইব্রাহীম আল-মাসরি। ইসরাইলি বিমান হামলা থেকে বাঁচতে বছরের পর বছর ধরে তাকে ঘন ঘন অবস্থান পাল্টাতে হয়েছে। জীবনযাপন করতে হচ্ছে অনেকটা যাযাবরের মত। এ কারণে তার নামের সাথে জুড়ে গেছে দেফ শব্দটি, যার অর্থ অতিথি।

জানা গেছে, শনিবার ভোরে তার নির্দেশের পর হামাস সদস্যরা ইসরাইলে হামলা শুরু করে। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে ইসরাইলের দিকে পাঁচ হাজার রেকট ছোঁড়া হয়। এর পাশাপাশি হামাসের কিছু সদস্য কাঁটাতারের বেড়া ভেঙ্গে, কিছু সদস্য প্যারা গ্লাইডারে চড়ে প্রতিরক্ষা দেয়াল ডিঙ্গিয়ে ইসরাইলের ভেতরে প্রবেশ করে অভিযান চালায়।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকা ঘেঁটে জানা যায়, দেফের জন্ম ১৯৬৫ সালে, গাযার খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে। গাজা তখন মিশরের দখলে। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধের পর গাজা ইসরাইলের দখলে চলে যায়। কৈশোর থেকে তিনি দেখে এসেছেন, ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরাইলের বর্বর নির্যাতন। ফিলিস্তিনিদের অসহায়ত্ব, তাদের স্বাধীনতার আকাঙ্খায় তিনি প্রভাবিত হয়েছেন।

হামাস যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন মোহাম্মদ দেফ একজন তরুণ। ১৯৮০র দশকের শেষে তিনি হামাসে যোগ দেন। হামাস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়। হামাসের সামরিক শাখা ‘ইজেদিন আল-কাসাম ব্রিগেডে’ মোহাম্মদ দেফ বেশ দ্রুত উপরের দিকে উঠতে থাকেন, তিনি বেশ বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। তিনি ২০০২ সালে কাসেম ব্রিগেডের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

হামাসের যে বিখ্যাত ‘কাসাম রকেট’, সেটির পরিকল্পনা এবং তৈরির কৃতিত্ব দেয়া হয় মোহাম্মদ দেফকে। গাযার ভূগর্ভে যেসব টানেল খনন করা হয়েছে, সেগুলোও নাকি মোহাম্মদ দেফের পরিকল্পনা। তিনি নাকি বেশিরভাগ সময় এসব টানেলের মধ্যে কাটান। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর চোখ এড়িয়ে এখান থেকেই তিনি হামাসের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

২০২১ সালে ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলের মধ্যে যে বড় সংঘাত হয়, তার পেছনেও দেফের বড় ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। ইসরায়েলের ফেরারি তালিকায় মোহাম্মদ দেফের নাম সবার উপরে।

দেফকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার উপর কমপক্ষে ৯ বার হামলা চালায় ইসরাইলের সশস্ত্র বাহিনী। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তার অবস্থানের উপর এসব চামলা চালানো হয়। এমনই এক হামলায় তিনি একটি চোখ হারান।

২০০৬ সালের হামলায় দেফ গুরুতর আহত হন বলে বিবিসিকে নিশ্চিত করেছিলেন ইসরাইলের সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের তৎকালীন প্রধান। এরপর তিনি আর কখনোই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু সবার ভুল ভেঙ্গে আবার তিনি সক্রিয় হয়ে উঠেন।

২০১৪ সালে গাযায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের সময় তার ওপর পঞ্চম হামলাটি চালানো হয়।

গাজার শেখ রাদওয়ান এলাকায় একটি বাড়ির ওপর ইসরায়েলিরা বিমান হামলা চালায়। হামলায় মোহাম্মদ দেফের স্ত্রী উইদাদ এবং তাদের শিশুপুত্র আলি নিহত হয়। ইসরায়েলিরা ভেবেছিল তারা মোহাম্মদ দেফকেও হত্যা করতে পেরেছিল। কিন্তু তিনি আসলে তখন সেই বাড়িতে ছিলেন না।

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.