ডলারের প্রকট আকারের সংকট এখন ‘আতঙ্ক’

যুদ্ধের প্রভাবে গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সময়ের মধ্যে নানা উদ্যোগ নিয়েও সংকট কাটানো সম্ভব হয় নি। দেশের অর্থনীতিতে এখন সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম ডলার। চাহিদা মতো ডলার না পাওয়ায় আমদানি ব্যয় কমাতে কঠোর হতে হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নেয়া নানা উদ্যোগেও লাগাম টানা যাচ্ছে না। রেমিট্যান্সের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ও আশানুরূপ পণ্য রপ্তানি না হওয়ায় অর্থনীতিতে চিন্তা আরও বাড়ছে।

খোলাবাজারে সর্বোচ্চ ১২০ টাকায় প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছিলো ২০২২ সালের আগস্টে। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে ২৫ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছিলো। এরপরে কার্ব মার্কেটে দাম কিছুটা কমতে থাকে। কয়েক মাস ধরে ১১২ থেকে ১১৩ টাকায় প্রতি ডলার বিক্রি হচ্ছিলো। তবে বর্তমানে আবারও ডলারের দাম বেড়েছে।

সোমবার (২ অক্টোবর) খোলাবাজার থেকে ডলার কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ১১৬ থেকে ১৭ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে ৬ টাকা থেকে ৭ টাকা বেশিতে ডলার বিক্রি হচ্ছে। তবে আজ গ্রাহক উপস্থিতি একেবারে কম। এদিন পল্টন ও মতিঝিল এলকার মানি চেঞ্জারগুলো ঘুরে এ চিত্র দেখা যায়।

খোলা বাজারের ব্যবসায়ীরা অর্থসূচককে বলেন, বর্তমানে বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিরা এখানে ডলার বিক্রি করতে আসতে ভয় পান। কারণ বাজার তদারকি করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠে নেমেছেন। আশেপাশে অনেককে ঘুরতে দেখা যায়। এর ফলে মানুষের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে।

আশরাফ তুহিন নামের এক ব্যক্তি এসেছিলেন ডলার কিনতে। আগামী ৬ অক্টোবরের ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর সহ তিন দেশে ঘুরতে যাবেন তিনি। তিনি বলেন, খরচের জন্য নগদ ডলার কিনতে কয়েকটি ব্যাংক ঘুরেছি কিন্তু ডলার পাইনি। এখন মানি চেঞ্জারে এসেছি, এখানে ডলার থাকলেও দাম অনেক বেশি। ব্যাংকের পরিচিত এক ব্যক্তিকে ফোন দিলাম ৬০০ ডলার ম্যানেজ করে দিতে। তিনিও দিতে ব্যার্থ হয়েছেন। তাই খোলাবাজার থেকে বাধ্য হয়ে ১১৭ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে।

তথ্য অনুযায়ী, এক বছর আগে প্রতি ডলার কিনতে ব্যয় হতো ৯৫ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। আর এখন ১ ডলার কিনতে হচ্ছে ১১০ থেকে ১১৬ টাকায়। অর্থাৎ গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ১৬ শতাংশের বেশি।

ডলারের এ সংকটে পণ্য আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে বাড়ছে পণ্যের দাম। বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি আরও চূড়ার দিকে যাচ্ছে। সংকটের মধ্যে অনেক ব্যাংক এলসি খুলতে পারছে না। এতে ভবিষ্যতে সংকট আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আলাউদ্দিন মজুমদার অর্থসূচককে বলেন, ডলার সংকট আতঙ্ক পর্যায়ে আসার অন্যতম প্রধান কারণ অর্থপাচার। অর্থপাচারকারীরা কিছু পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। যেমন, আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং-এর মাধ্যমে পরিশোধ মূল্যের চাইতে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে পাঠানো হয়। রপ্তানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে রপ্তানি আয়ের একটা অংশ বাইরে রেখে দেওয়া হয়। আবার হুন্ডির মাধ্যমেও পাচার হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে রেমিট্যান্স প্রেরকদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বেশি দামে ক্রয় করে বিনিময়ে দেশে টাকার মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। এতে রেমিট্যান্সের মাধ্যমে যে বৈদেশিক মুদ্রা দেশের রিজার্ভে যুক্ত হওয়ার কথা ছিল তা বিদেশেই থেকে যাচ্ছে।

ক্রমাগতভাবে পাচারকারীদের অবৈধ উপার্জন বেড়েছে। অবৈধভাবে উপার্জিত এই অর্থ ভবিষ্যতে দেশে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে, মূলত এই ভেবে তারা পাচারের আশ্রয় নেয়। এর ফলে পাচার এমন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌছেছে বলেও মনে করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, পাচারকারীরা মুলত রাজনৈতিক আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে লালিত হয়। তাই প্রথমত ইতিবাচক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত হুন্ডি রোধে রেমিট্যান্সের উৎস দেশগুলোর সরকারের সাথে একটা সমঝোতায় আসা প্রয়োজন, যাতে করে ওই সকল সরকার হুন্ডির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। ইতোমধ্যে আরব আমিরাত হুন্ডি-বিরোধী ব্যবস্থা নেওয়ায় সেখান থেকে রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেড়েছে। এছাড়া অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত কম প্রয়োজনীয় এবং বিলাসী দ্রব্যের আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা উচিৎ। ওভার ইনভয়েসিং-আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নাওয়াও সময়ের দাবি।

জানা যায়, ডলারের কারসাজি রোধে খোলা বাজার ও এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোয় ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গোয়েন্দা সংস্থারসদস্যদের সঙ্গে নিয়ে এ পরিদর্শন কার্যক্রম চালানো হয়।

সম্প্রতি বেসরকারি খাতের ১০টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ডলার কারসাজিতে জড়িয়ে পড়েছে। বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় ঐ ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার কারসাজির সঙ্গে জড়িত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ধারার ৩টি ব্যাংক রয়েছে। এছাড়া প্রচলিত ধারার রয়েছে ৭টি ব্যাংক।

অর্থসূচক/ সুলাইমান

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.