ঢাবির হল থেকে পড়ে শিক্ষার্থীর মৃত্যু

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হল থেকে নিচে পড়ে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার রাত একটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। নিহত শিক্ষার্থীর নাম কাজী ফিরোজ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইনিজ ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের ২০৩ নম্বর রুমের আবাসিক ছাত্র সে। তার বাড়ি গোপালগঞ্জে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনামতে, তিনি হলের যমুনা ব্লকের ছয় কিংবা সাত তলা থেকে লাফ দিয়েছেন। তবে এটি আত্মহত্যা কি না তা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এ তথ্য নিশ্চিত করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে আহত অবস্থায় মেডিকেলে আনা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।’

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিজয় একাত্তর হলের ছাত্র ওয়াহিদুল আলম বলেছেন, ‘আনুমানিক ১২টা ৫০-৫৫ মিনিটে বিজয় একাত্তর হল মাঠে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলাম। এ সময় আমি ‘আল্লাহরে’ বলে একটা চিৎকার শুনতে পাই। এরপর সেই ব্লকের লিফটের দিকে তাকালে দেখি, উড়ন্ত লুঙ্গির মতো কিছু একটা নিচে পড়ে যাচ্ছে। এরপর বিকট একটা শব্দ হয়। বুঝলাম কেউ হয়ত লাফ দিয়েছে বা পড়ে গেছে। তৎক্ষণাত আমি সেখানে দৌঁড়ে যাই। পাশের রিডিং রুম থেকে আরও কয়েকজন ভাই দৌড়ে ঘটনাস্থলে আসেন। ওনার পরনে একটা লুঙ্গি এবং গলায় একটা গামছা ছিল। ওনার শরীর ছিল ঘর্মাক্ত। সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছেন। এরপর এক ভাই ওনার মুখে পানি দিয়ে বুকে পাঞ্চ করলে উনি নিশ্বাস নেওয়া শুরু করেন। পরে ওনাকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।’

বিজয় একাত্তর হলের আরেক শিক্ষার্থী শেখ রাব্বী বলেন, ‘আমি দৌড়ে নেমে এসে দেখি, তার হুঁশ নেই। এরপর তাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য রিকশায় তুলে দেই। যখন তাকে আমি ধরেছি, তার শরীরটা একদম তুলতুলে ছিল। মনে হচ্ছে, সব হাড় ভেঙে গেছে। তবে তার কোনো ব্লিডিং হয়নি। আর সেসময় আমি তার বুকে হাত দিয়ে দেখেছিলাম পালস ছিল।’

এ দিকে ফিরোজের বেডমেট মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘আমি লাইব্রেরি থেকে যখন রুমে আসি, এর কিছুক্ষণ পর ফিরোজ রুমে আসে। সাড়ে ১০টার দিকে সে সবাইকে বলে, ‘তোরা কেউ আমার কাছ থেকে কোনো টাকা পাস কি না বল। এমনকি দুই টাকা হলেও বল। আমি দিয়ে দিতে চাই। পেলে এখনই বল।’ এর কিছুক্ষণ পর সে মানিব্যাগ এবং মোবাইল রেখে রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। তখন আমি বলি, কই যাচ্ছিস? সে বলে, ‘আমি একাত্তর হলে যাচ্ছি, একটু কাজে।’ এরপর আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি।’

কাজী ফিরোজের আরেক বন্ধু আবদুল্লাহ বলেন, ‘কবি জসিমউদদীন হল মাঠে আনুমানিক রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার দিকে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। অনেকদিন পর দেখা হওয়ায় কুশল বিনিময় করলাম। পরে সে আমার মোবাইল নিয়ে কাকে যেন ফোন দিয়েছিল। তখন তাকে ডিপ্রেসড মনে হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পর সে আমার মোবাইল ফেরত দিয়ে দেয়। পরে আমি চলে আসি।’

ফিরোজের এক রুমমেট বলেন, ‘‘রাত ১০টার পরে সে রুমে আসে। তার জন্য তার টেবিলে খাবার রাখা ছিল। আমি তাকে বলি, খাবার তো নষ্ট হয়ে যাবে। খাবার খেয়ে নে। সে বলে, ‘খামু।’ এরপর সে ওযু করে এসে নামাজ পড়েছে। নামাজ শেষে সে তার টেবিলে বসল। আমরা ভেবেছি, সে হয়ত পড়তে বসেছে। এরপর আমরা রুমের লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়ি। এরপর সে বের হয়ে যায়। এ সময় তার বেডমেট জিজ্ঞেস করল, ‘কই যাস?’ তখন সে বলে, ‘আসতেছি।’ এর অল্প সময় পর আমরা খবর পাই, বিজয় একাত্তর হল থেকে কেউ একজন নিচে লাফ দিয়েছে। এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি শোয়া থেকে উঠে পড়ি। যেহেতু ফিরোজ শেষ কিছুদিন ধরে একটু ডিপ্রেসড ছিল, তাই আমি সবাইকে বলি, ফিরোজ কই? দেখি, রুমে ফিরোজ নেই। এরপর আমরা সবাই দৌড় দিয়ে বিজয় একাত্তরের সামনে আসি। ততক্ষণে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আমরা হাসপাতালে এসে দেখি, ফিরোজই।’

রাত আড়াইটার দিকে ফিরোজের রুমে গিয়ে তার টেবিলে একটি খাতা অর্ধখোলা অবস্থায় রাখা পাওয়া যায়। ফিরোজের বন্ধুরা এটি তার লেখা বললেও এটি কার লেখা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সে খাতায় পৃষ্ঠার ওপরের তারিখের জায়গায় লেখা ছিল ‘১/০৯/২৩’। আর এর নিচে লেখা, ‘মানুষ বাঁচে তার সম্মানে। আজ মানুষের সামনে আমার যেহেতু সম্মান নাই, এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আমার কোনো অধিকার নাই। আমার মৃত্যুর দায়ভার একান্ত আমার। সরি মা! বাড়ি থেকে তোমাকে দিয়ে আসা কথা রাখতে পারলাম না। আমার জীবন নিয়ে হতাশ।… ফিরোজ রাত: ১১টা ৩।’

একই পৃষ্ঠায় নিচে লেখা আছে, ‘আমার ওয়ালেটের কার্ডে কিছু টাকা আছে। বন্ধুদের কাছে অনুরোধ রইল মায়ের হাতে দিতে। কার্ডের পাসওয়ার্ড ৮০৭৯, আর ফোনের লক খুলে দিয়ে গেলাম। আমার লাশের পোস্টমর্টেম না করে যেন বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কোনোরূপ আইনি ঝামেলায় কাউকে যেন জড়ানো না হয়। সবাই বাঁচুক। শুধু শুধু পৃথিবীর অক্সিজেন আর নষ্ট করতে চাই না।… ফিরোজ।’ এর নিচে লেখা হয়েছে, ‘রাত ১১টা ৫।’

মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যতটুকু এভিডেন্স আমাদের কাছে আছে, এটা একটা সুইসাইড। কারণ, তার সুইসাইড নোটও পাওয়া গেছে। সে যখন রুম থেকে বের হয়েছে, তার মোবাইল, মানিব্যাগ, সুইসাইড নোট রুমে রেখে এসেছে।’ ফিরোজের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।

অর্থসূচক/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.