শীর্ষ ছয় খেলাপির কাছে অগ্রণী ব্যাংকের আটকা ৪৫০০ কোটি টাকা

বিপুল অঙ্কের খেলাপি থেকে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রতিষ্ঠান অগ্রণী ব্যাংক। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের ৩০ শতাংশ দেশের ছয়টি গ্রুপ প্রতিষ্ঠানের কাছে আটকে আছে। এই গ্রুপগুলোর কাছে মোট ৪ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়ে আছে। এসব অর্থ আদায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েও তেমন লাভ হচ্ছে না।

অগ্রণী ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, শীর্ষ ছয় ঋণখেলাপির মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে জাকিয়া গ্রুপ। এই গ্রুপের কাছে ব্যাংকের পাওনা ১ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা।  এছাড়া আলোচিত তানাকা গ্রুপের কাছে ৭৭৬ কোটি টাকা, শিকদার গ্রুপের কাছে ৬১৯ কোটি টাকা, সোনালী গ্রুপের কাছে ৫৭৬ কোটি টাকা এবং মুন গ্রুপের কাছে ৩৭৬ কোটি টাকা আটকে আছে রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকটির।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে অগ্রণী ব্যাংকে মোট বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৭৩ হাজার ৬ কোটি টাকা। বিতরণকৃত ঋণের ২১ দশমিক ১০ শতাংশই এখন খেলাপি। অর্থাৎ অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৫ হাজার ৪০৮ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।

খেলাপি ঋণ আদায়ে অগ্রণী ব্যাংক কি ধরণের উদ্যোগ নিয়েছে, তা জানতে অর্থসূচকের পক্ষ থেকে মুঠোফোনে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুরশেদুল কবীরের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। তবে ব্যাংকটির এমডি কল ধরেন নি। এরপরে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো লিখিত প্রশ্নেরও কোনো উত্তর দেননি তিনি।

সূত্র মতে, অগ্রণী ব্যাংকের ঋণের ৭৩ শতাংশ ৪৪ গ্রাহকের কাছে। এসব গ্রাহকদের কাছে ৫৩ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। অর্থাৎ ৪৪ ঋণগ্রহীতার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ব্যাংকটি। ঐ ঋণের মধ্যে রয়েছে ২৩ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকার ফান্ডেড লোন এবং ২৯ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা নন-ফান্ডেড লোন।

ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এক যুগ আগে অর্থাৎ ২০১০ সালে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র ১৬ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। অপরদিকে গত ডিসেম্বর শেষে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৭৩ হাজার ৬ কোটি টাকা। এই সময়ের মধ্যে আমানতের পরিমাণ ৭২ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা বেড়েছে। ২০১০ সালের ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ ছিলো ২০ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা। আমানত ও ঋণের পরিমাণ বাড়লেও সুদ খাতের আয় ব্যাপকভাবে কমেছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন অর্থসূচককে বলেন, অগ্রণী ব্যাংক এক সময় ব্যবস্থাপনার দিক থেকে বেশ সুনামের সাথে কাজ করেছে। বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে আর্থিক খাতকেও সেটির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এই খাতকে আধুনিক হতে হবে এবং আরও নতুন নতুন সেবা দিতে হবে। অগ্রণী ব্যাংক শুধু ব্যাংকিং করে তা নয়, সরকারি অনেক সেবা প্রদানে তাদের অংশগ্রহণ করতে হয়। এইরকম একটি ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ ঋণ আটকে থাকা মানে তাদের মূলধন ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এটি সরকারি ব্যাংক হওয়ায় আমানতকারীরা মূলধন ঘাটতি নিয়ে বেশি একটা চিন্তা করেন না। কারণ তারা ভাবেন যে, এই ঘাটতি সরকারি বাজেট থেকে পূরণ করে দেওয়া হবে। ব্যবস্থাপনার দূর্বলতা যেখানে দৃশ্যমান সেখা করদাতাদের টাকা দিয়ে টিকিয়ে রাখা এসব অর্থের অপচয়।

তিনি আরও বলেন, এত বড় বড় গ্রুপের কাছে টাকা আটকে আছে, আর সেই অর্থ ব্যাংক আদায় করতে পারছে না। এসব বড় গ্রুপকে ব্যাংক থেকে অনেক বেশি সুবিধাও দেওয়া হয়েছে। অথচ কৃষকরা এক লাখ টাকা ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে মামলা হয়ে যায়। বড় খেলাপিরাও ঋণ ফেরত দিতে ব্যর্থ, আবার কৃষকেরাও ঋণ দিতে পারে না। তবে এখানে একজনকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হয়। আর যার হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাপি তিনি খুব সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে। বড় গ্রুপকে সুযোগ-সুবিধা আরও বেশি করে দেওয়া হয়। এতে শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয় এবং অন্যরা দেখে উৎসাহিত হয়। এরফলে আর্থিক খাতের উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হয়।

এর আগে ২০২১ সালে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ছিল ১৭ শতাংশ। খেলাপির এই হার ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছিলো বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ৯ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৫ হাজার ৪০৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২১ দশমিক ১০ শতাংশ।

গত বছর থেকে দেশে ব্যাপকভাবে ডলার সংকট দেখা দেয়। সংকট কাটাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয় আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। সংকটকালীন মূহুর্তে এক বছরে ডলার আহরণে অগ্রণী ব্যাংকের অবদান কমেছে ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। ২০২১ সালের পুরোটা সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকটির মাধ্যমে প্রবাসীরা ১৭৯ কোটি ৬১ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। গত বছরে এসেছে ১৩২ কোটি ৪৭ লাখ ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যাবধানে ব্যাংকটির মাধ্যমে রেমিট্যান্সের আসা কমেছে ৪৭ কোটি ১৪ লাখ ডলার।

অগ্রণী ব্যাংকের তথ্য বলছে, এক যুগ আগে ২০১০ সাল শেষে অগ্রণী ব্যাংকের মোট সম্পদ ছিল ২৬ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা। এরপর ২০২২ সাল শেষে ব্যাংকটির সম্পদের আকার ১ লাখ ১৪ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ব্যাংকটির সম্পদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৩৪ শতাংশ। সম্পদের আকার চার গুণ বাড়লেও ব্যাংকটির মুনাফা কমেছে। ২০১০ সালে অগ্রণী ব্যাংকের নিট মুনাফা ছিল ৩৫১ কোটি টাকা। আর গত বছর ব্যাংকটি মাত্র ১৪১ কোটি টাকা নিট মুনাফা দেখাতে পেরেছে।

গত বছর শেষে অগ্রণী ব্যাংক ২ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংকটির ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের হার (সিআরএআর) ন্যূনতম সাড়ে ১২ শতাংশ হওয়ার কথা। যদিও এক্ষেত্রে ব্যাংকটির সিআরএআর রয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ। অথচ এক যুগ আগে সঞ্চিতি সংরক্ষণ ও মূলধনের দিক থেকে বেশ স্বাবলম্বী ছিল অগ্রণী ব্যাংক।

অর্থসূচক/সুলাইমান/এমএস

মন্তব্য
Loading...