উৎপাদন খরচের বিপরীতে সঠিক দাম না পাওয়া, অপপ্রচার এবং বাজার তদারকি সংস্থার চাপের কারণে পোল্ট্রি খাতের প্রান্তিক খামারিরা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এরই মধ্যে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে, কমেছে উৎপাদন। এ অবস্থা চলতে থাকলে ডিম-মাংসের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে, দেখা দেবে পুষ্টি ঘাটতি। তাই প্রান্তিক খামারিদের সুরক্ষা এবং কম দামে সবার জন্য ডিম ও মুরগি নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা।
বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট) ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) এবং বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের নেতারা এ আহ্বান জানান।
এতে উপস্থিত ছিলেন ফিড উৎপাদনকারীদের সংগঠন ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশন বাংলাদেশ (এফআইএবি); মুরগির বাচ্চা উৎপাদনকারীদের সংগঠন- ব্রিডার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএবি); প্রান্তিক খামারি ও উদ্যোক্তাদের সংগঠন- বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রিজ এসোসিয়েশন (বিপিআইএ); ওষুধ ও ভ্যাকসিন সরবরাহকারীদের সংগঠন- এনিমেল হেলথ কোম্পানীজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আহকাব); ভুট্টা, সয়াবিনসহ ইনপুট সাপ্লায়ারদের সংগঠন- বাংলাদেশ এগ্রো ফিড ইনগ্রিডিয়েন্টস ইম্পোর্টার্স এন্ড ট্রেডার্স এসোসিয়েশন (বাফিটা) এবং বিজ্ঞানী, স্পেশালিষ্ট, রিসার্চার ও একাডেমিশিয়ানদের সংগঠন- ওয়ার্ল্ডস পোল্ট্রি সায়েন্স এসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখার (ওয়াপসা-বিবি) নেতারা।
বিপিআইসিসির সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, ২০২২ ও ২০২৩ সালের বেশিরভাগ সময় ডিম ও মুরগি উৎপাদনকারী খামারিরা লোকসান করেছেন। উৎপাদন খরচের চেয়েও কম মূল্যে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়েও খামারিরা চেষ্টা করেছেন উৎপাদন সচল রাখতে। দেশের মানুষের জন্য পুষ্টি সরবরাহ অব্যাহত রাখতে। এজন্য তাদের প্রশংসা পাওয়ার কথা ছিল অথচ খামারি ও উদ্যোক্তাদের ললাটে জুটেছে অপবাদ আর অপমান। মধ্যস্বত্বভোগীরা অন্যায্য মুনাফা করেছে অথচ খড়্গ নেমেছে উৎপাদকদের ওপর। এভাবে বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে না। খামারিরা লাভ করতে পারলে যারা সরে গেছে তারা আবারও ফিরে আসবে। উৎপাদন বাড়লে বাজারও স্থিতিশীল হবে। পোল্ট্রি শিল্পের চলমান সংকট নিরসনের মাধ্যমে এ খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
ব্রিডার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান বলেন, ডিম ও মুরগির খামারি-উদ্যোক্তারা মিথ্যা কথা বলছেন। শত শত কোটি টাকা লুটে নিয়ে যাচ্ছেন। ডিম-মুরগির বাজারে সিন্ডিকেট! এমন অপপ্রচার ছড়ানোর কারণে বিভ্রান্তি দিন দিন আরও ঘণীভূত হয়েছে। তাছাড়া ‘প্রান্তিক খামারি’ বনাম ‘করপোরেট খামারি’র বিতর্ক সৃষ্টির মাধ্যমেও দেশীয় খামারি ও উদ্যোক্তাদের অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর অপচেষ্টা হচ্ছে। ডিম-মুরগি আমদানি করা হলে তা দেশেরই ক্ষতি করবে। একদিন বয়সী ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক চাহিদা যেখানে ছিল প্রায় ১ কোটি ৭০-৮০ লাখ, বর্তমানে তা ১ কোটি ৩০ লাখে নেমে এসেছে। লেয়ার মুরগির চাহিদা ১১ লাখ থেকে কমে হয়েছে সাড়ে ৯ লাখ।
মাহাবুবুর রহমান বলেন, ২০২২ সালে একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নাকি শত শত কোটি টাকা লোপাট করেছিল- এমন প্রচারণা চালানো হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা ছিল একেবারেই উল্টো। লাভ তো দূরের কথা ব্রয়লার ও লেয়ার খামারিদের লোকসান হয়েছিল প্রায় ৪৬৫ কোটি টাকা। মাত্র কয়েকদিনের মূল্যবৃদ্ধিকে একটি চক্র হীন স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছিল। ডিম ও মুরগি একই দিনে একই মার্কেট এবং দেশের বিভিন্ন মার্কেটে একেক দামে বিক্রি হচ্ছে। যেখানে ক্ষুদ্র খামারিরা প্রধান উৎপাদক ও সেখানে সরবরাহকারী সিন্ডিকেট করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, এক সময় বলা হয়েছিল কাজী ফার্মস, প্যারাগন বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে অথচ এবার ডিমের মূল্যবৃদ্ধির সময় এ দু’টি প্রতিষ্ঠানসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মূল্য বৃদ্ধি না করলেও বাজারে দাম বেড়েছে। কাজেই আমাদের বুঝতে হবে যে, একটি স্বার্থান্বেষী মহল দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প ধ্বংসের লক্ষ্যেই করপোরেট ও প্রান্তিক খামারির বিতর্ক সৃষ্টি করছে। এদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে।
ফিড ইন্ডাষ্ট্রিজ এসোসিয়েশন বাংলাদেশের (এফআইএবি) সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে ভুট্টা, সয়াবিন মিলসহ ফিড তৈরির অন্যান্য উপকরণ এবং ওষুধের দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে। ডলার সংকটের কারণে এলসি করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে এনওসি দিয়ে আমদানি করা ফিড গ্রেড পণ্যকেও ফুড গ্রেড লেবেল দিয়ে উচ্চহারে শুল্কায়ন করা হচ্ছে; আবার মিস ডিক্লারেশনের অভিযোগে একই সাথে ২০০ শতাংশ জরিমানা করা হচ্ছে। সাগরে কয়েকটি জাহাজ ভাসছে। প্রতিদিন প্রতিটি জাহাজকে কয়েক হাজার ডলার করে জরিমানা গুনতে হচ্ছে। এসব কিছুর কারণেও উৎপাদন খরচে লাগাম টানা যাচ্ছে না।
এনিমেল হেলথ কোম্পানিজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আহকাব) সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আফতাব আলম বলেন, প্রায়শই খামার ও খুচরা বাজারের মাঝে বড় ধরনের ফারাক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ১০.৭৫ টাকায় উৎপাদিত ডিমের সাথে ২ টাকা যোগ করলেও খুচরা পর্যায়ে ডিমের দাম ১২.৭৫টাকার বেশি হওয়া সমীচিন নয় অথচ বাজারে তা ক্ষেত্র বিশেষে ১৫টাকা এমনকি কোথাও কোথাও ১৭ টাকা পর্যন্ত উঠতে দেখা গেছে। আইনসিদ্ধ মুনাফার চেয়েও অনেক কম লাভ করা সত্ত্বেও হেনস্তা হচ্ছেন উৎপাদক-খামারিরা। ব্রয়লার মুরগির বাজারে খামার থেকে ভোক্তা পর্যায়ের মাঝে ৪০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত ফারাক থাকছে যেখানে খামারি হয়তো লাভ করছেন কেজিতে মাত্র ৩-৪ টাকা। কখনও আবার লোকসানেও বিক্রি করতে হচ্ছে কিন্তু তখনও মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের মুনাফায় কোনো কমতি হচ্ছে না। তাহলে খামারি টিকবে কীভাবে? এ অবস্থার উন্নয়নে তিনি বাজার তদারকি সংস্থার হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য রাখেন, ফিড ইন্ডাষ্ট্রিজ এসোসিয়েশন বাংলাদেশের (এফআইএবি) সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম, এনিমেল হেলথ কোম্পানিজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আহকাব) সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আফতাব আলম, ওয়ার্ল্ড’স পোল্ট্রি সায়েন্স এসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখার সহ-সভাপতি মো. তৌহিদ হোসেন, বাংলাদেশ এগ্রো ফিড ইনগ্রিডিয়েন্টস ইম্পোর্টার্স এন্ড ট্রেডার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি সুধীর চৌধুরী, ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম প্রমুখ।
অর্থসূচক/এমএস



মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.