সাল ১৯১৭! প্রথমবারের মতো একটি স্বয়ংক্রিয় গাড়ি প্রস্তুত করে মিতসুবিশি শিপবিল্ডিং কোম্পানি লিমিটেড। সেই গাড়িটির নাম ছিল মিতসুবিশি মডেল-এ। মূলত সরকারী কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্য ডিজাইন করা হয়েছিলো গাড়িটি। জাপানের ইতিহাসে প্রথম গণউতপাদিত এই গাড়িটির মাধ্যমে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করে মিতসুবিশি মোটরস।
বিখ্যাত কথাশিল্পী অ্যালান মুর তার এক রচনায় বলেছিলেন, একটি আইডিয়াই বদলে দিতে পারে গোটা বিশ্বকে! মাত্র পঞ্চাশ বছরের জীবনকালেই পৃথিবীতে এক সমৃদ্ধির ইতিহাসের বীজ বপন করেছিলেন মিতসুবিশি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ইয়াতারো ইওয়াসাকি। গড়ে তুলেছিলেন এক বিশাল বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের ভিত। আর তার মৃত্যুর পরও সেই পরম্পরা ধরে রাখেন তার পরিবারের সদস্যরা। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই, নিত্যনতুন উদ্ভাবনী কার্যক্রমের মাধ্যমে মিতসুবিশি গ্রুপটি সম্পৃক্ত হয় বিভিন্ন স্ব-শাসিত কোম্পানির সাথে। অগ্রসর হয় কাগজ, লৌহশিল্প, কাঁচ, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি, তেল, আবাসন সহ আরো নানা দিকে।
এর পরপরই এগুলোর পাশাপাশি কোম্পানি অটোমোবাইল, উড়োজাহাজ, ট্যাঙ্ক, বাস সহ আরো নানা ধরনের যানবাহন তৈরি করতে শুরু করে এবং মিতসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ নামে আত্মপ্রকাশ করে। আর সেখান থেকেই জন্ম হয় মিতসুবিশি মোটরসের। বর্তমানে এই কোম্পানিটি বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম গাড়ি প্রস্ততকারক কোম্পানি। মিতসুবিশি মোটরস এখন শুধু একটি নামই নয়, বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা অটোমোটিভ ব্র্যান্ডের একটি।
কোনো গাড়ির কেরামতি প্রদর্শনীর জন্যে রেস ট্র্যাক ছাড়া উপযুক্ত দ্বিতীয় কিছু নেই। আর সেটা বাস্তবায়ন করতেই যেন সম্ভাবনা এসে দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে ১৯৬২ সালের দিকে। সেই বছর কোম্পানি আন্তর্জাতিক মোটর স্পোর্টস ইভেন্ট ম্যাকাও গ্র্যান্ড প্রিতে প্রথম এন্ট্রি জেতার সৌভাগ্য অর্জন করে। আর অবিলম্বেই কোম্পানির নতুন গাড়ি মিতসুবিশি ৫০০ সুপার ডিলাক্স টুর্নামেন্টে নতুন ট্র্যাক রেকর্ড গড়তে সক্ষম হয়। জাপানের প্রথম বায়োডায়নামিকভাবে পরীক্ষিত গাড়ি ছিল এই মিতসুবিশি ৫০০ সুপার ডিলাক্স। এই ইভেন্টটি মিতসুবিশি মোটরের জন্যে এক উদ্ভাবনী প্রযুক্তির গতিপথ ঠিক করে দেয়, যা তাদের মোটরগাড়ি শিল্পে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
১৯৭০ এর দশকে ইলেকট্রিক বাহনের প্রস্ততকারক হিসেবে প্রথমবারের মতো আত্মপ্রকাশ করে মিতসুবিশি মোটরস। ইলেকট্রিক ভেহিকেল বা (ইভি) প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার উন্নতি সাধনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তারা। একই বছর জাপানে গ্যালান্ট জিটিও নিয়ে আসে মিতসুবিশি; পাঁচ বার গ্র্যান্ড প্রিক জয়ী কোল্ট এফ সিরিজ থেকেই প্রস্তুত করা হয়েছিল গাড়িটি। মজার ব্যাপার হলো, এখান থেকেই বিবর্তনের ধারায় ধীরে ধীরে আলোর মুখ দেখে আইকনিক গাড়ি ল্যান্সার।
১৯৭৩ সালে ল্যান্সার ১৬০০ জিএসআর দিয়ে বাজারে পদার্পণ করে ল্যান্সার সিরিজের প্রথম গাড়ি। অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণাংশের ক্রস র্যালিতে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে গাড়িটি। বিশ্বব্যাপী গর্জন শুরু হয় ল্যান্সারের নামে। চারবার করে শিরোপা জেতা মিতসুবিশীর কাছে বিজয় যেন স্বভাবে পরিণত হয়।
এর ঠিক ৩ বছর পরে, ১৯৭৬ সালে, মোটরগাড়ি শিল্পে আরেকটি যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয় মিতসুবিশি মোটরস। ‘সাইলেন্ট শ্যাফট ইঞ্জিন’ প্রযুক্তি, যা বর্তমানে ইঞ্জিনের মসৃণ গতি নিশ্চিতকারী ‘ব্যালান্স শ্যাফট’ নামে পরিচিত, একে আরও উন্নত করতে সক্ষম হয় তারা। পোরশে, সাব আর ফিয়াটের উদ্ভাবন প্রযুক্তির লাইসেন্স এবং স্বত্ত্বাধিকার নিজেদের কাছে রেখে দেয়। ১৯৮০ সালে উদ্ভাবনের এই সিলসিলাকে আরেক ধাপ সামনে এগিয়ে নিয়ে যায় মিতসুবিশি। সাইলেন্ট শ্যাফট প্রযুক্তির সাহায্যে তারা তৈরি করে বিশ্বের প্রথম টার্বো ডিজেল ইঞ্জিন।
মিতসুবিশি গ্রুপ তিনটি মূলনীতি অনুসরণ করে- ‘Shoki Hoko: করপোরেট ও সামাজিক দায়িত্ব’, ‘Shoji Komei: সংহতি ও স্বচ্ছতা’ এবং ‘Ritsugyo Boegi: ব্যবসায়ের মাধ্যমে বৈশ্বিক পরিচয়’।
এ মুহুর্তে মিত্সুবিশি মোটরস বিশ্বের অটোমোটিভ শিল্পের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর একটি। জনসাধারণের চাহিদা পূরণের মাধ্যমেই নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে তারা। তাদের কারিগরি প্রযুক্তির ভবিষ্যৎমুখী কৌশল এবং প্রতিটি ছোটোখাট ব্যাপারেও তাদের অবিচ্ছিন্ন মনোযোগ, প্রতিটি পদক্ষেপ বাজারে উপস্থিত প্রতিযোগীদের দ্বারা প্রতিনিয়ত কীভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে জেনে সেই অনুসারে কাজ করে চলা- এ ব্যাপারগুলো তাদেরকে আরও নতুন কিছু উদ্ভাবনের জন্য অনুপ্রেরণা যোগায়।
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.