সড়ক নিরাপত্তার জন্য আচরণগত ঝুঁকিসমূহের পর্যবেক্ষনের ফলাফল উপস্থাপন

সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যু ও দীর্ঘমেয়াদী পঙ্গুত্বের অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত ‘গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেইফটি ২০১৮’ এর তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় (রোড ক্রাশ) প্রায় ১৩ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়াও ২০-৫০ লক্ষ মানুষ বিভিন্ন মাত্রায় আহত হয় বা পঙ্গুত্বের শিকার হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ২৪,৯৫৪ জন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনার সমস্যা মোকাবেলার জন্য ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিসের অর্থায়নে ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস ইনিশিয়েটিভ ফর গ্লোবাল রোড সেইফটি (বিআইজিআরএস) নামক প্রকল্প চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পটি ঢাকাসহ বিশ্বের ১৫ টি দেশের ২৮ টি শহরে বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিআইজিআরএস প্রকল্পের অংশ হিসেবে জন্স হপকিনস ইন্টারন্যাশনাল ইনজুরি রিসার্চ ইউনিট (জেএইচ-আইআইআরইউ) সিআইপিআরবি’র সাথে পর্যায়ক্রমে রোডসাইড অবজারভেশনাল স্টাডি পরিচালনা করছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে সড়ক নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকির কারণসমূহের মূল্যায়নের জন্য ২০২১ সালের আগস্ট মাস থেকে মোট তিন রাউন্ড তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এই তথ্যসমূহের ফলাফলের ভিত্তিতে এবং মূল সুপারিশগুলো তুলে ধরে একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

রবিবার (১৬ জুলাই) ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সম্মেলন কক্ষে স্ট্যাটাস সামারি রিপোর্ট ২০২২ উন্মোচনের জন্য একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ডিএনসিসি, জেএইচ-আইআইআরইউ, সিআইপিআরবি এবং ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিস যৌথভাবে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোঃ সেলিম রেজা। উক্ত অনুষ্ঠানে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা সহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ এবং বাংলাদেশের বিআইজিআরএস অংশীদার সংস্থার প্রতিনিধিগণ, একাডেমিক প্রতিষ্ঠান এবং সুশীল সমাজের বিভিন্ন সংস্থাসমূহের প্রতিনিধিগণ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে ভবিষ্যতে এই প্রতিবেদনের ফলাফল কিভাবে ব্যবহার করা যায় সে সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান করেন।

ডাঃ সেলিম মাহমুদ চৌধুরী, পরিচালক, সিআইপিআরবি প্রতিবেদন প্রকাশনা অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যসমূহ তুলে ধরেন। জন্স হপকিনস ইন্টারন্যাশনাল ইনজুরি রিসার্চ ইউনিট (জেএইচ-আইআইআরইউ) এর পক্ষে ডাঃ শিরিন ওয়াধানিয়া প্রতিবেদনের ফলাফল উপস্থাপন করেন। ডাঃ শিরিন ওয়াধানিয়া তার উপস্থাপনায় উল্লেখ করেন যে, ২০২১ সালে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে রিপোর্টকৃত ৮৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা ব্যবহারকারীগণ (পথচারী, মোটরসাইকেল চালক এবং সাইকেল চালক) দায়ী। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ১০ শতাংশ গাড়ির অতিরিক্ত গতি লক্ষ্য করা যায়। গতি সীমা অতিক্রম করার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ট্রাকগুলোর (৮০ শতাংশ) মধ্যে। ভোরে (সকাল ৪:৩০ থেকে সকাল ৬:০০ ঘটিকার মধ্যে) পর্যবেক্ষন করা যানবাহনগুলোর ৪৯ শতাংশ গতি সীমা অতিক্রম করে যাতায়াত করছিল। মোটরসাইকেল চালকদের মধ্যে হেলমেট ব্যবহারের হার ছিল সন্তোষজনক (৯২ শতাংশ)। কিন্তু আরোহীদের মধ্যে সঠিকভাবে হেলমেট ব্যবহারের হার ছিল মাত্র ৪৭ শতাংশ এবং শিশুদেও মধ্যে তা ছিল আরো কম (৩১ শতাংশ)। যানবাহন চালকদের মধ্যে সিটবেল্ট ব্যবহারের হার ছিল মাত্র ৫৭ শতাংশ এবং যাত্রীদের মধ্যে এই হার ছিল খুবই কম (৫ শতাংশ)। যানবাহনে যাতায়াতকারী শিশুদের মধ্যে কাউকেই চাইল্ড-সিট বা চাইল্ড-রেস্ট্রিয়েন্ট ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।

প্যানেল আলোচকদের একজন মোঃ শরীফ উদ্দিন, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, ডিএনসিসি বলেন, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সড়ক প্রকৌশল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি আরও বলেন যে, সারা দেশে নতুন রাস্তার নকশা বা বিদ্যমান রাস্তাগুলো উন্নত করার সময় প্রকৌশল নীতিগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে।

আরেকজন প্যানেলিস্ট শেখ মাহবুব ই রব্বানী, ডাইরেক্টর, রোড সেইফটি, বিআরটিএ বলেন যে, সকল ধরনের রাস্তার জন্য গতিসীমা নির্ধারণে এবং নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বিআরটিএ কাজ করে যাচ্ছে।

মোহাম্মদ মামুনুর রহমান, সিনিয়র রোড সেইফটি স্পেশালিস্ট, ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ) উল্লেখ করেন যে, ডিটিসিএ পথচারী বান্ধব রাস্তা পারাপারের উপাদানগুলোর প্রকৌশল নকশা ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সাথে শেয়ার করেছেন। এছাড়াও তাদের (ডিটিসিএ) নিজস্ব ওয়েবসাইটে পথচারী বান্ধব রাস্তা পারাপারের উপাদানগুলোর প্রকৌশল নকশা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন।

ডাঃ নুসায়ের চৌধুরী, ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার, নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর উল্লেখ করেন যে রোড সেইফটির এর অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নানাবিদ কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের জন্য একটি স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড কস্টেড অ্যাকশন প্লান তৈরী করা, সড়ক দুর্ঘটনায় হতা-হত ও পঙ্গুত্ব বরণকারী ব্যক্তিদের সার্বিক চিত্র জানার জন্য গবেষণা পরিচালনা করা এবং সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের জরুরী ফার্স্ট-এইড সেবা প্রদানের জন্য স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরী করা ইত্যাদি।

ডাঃ সোহেল রেজা চৌধুরী, ডাইরেক্টর, ডিপার্টমেন্ট অফ ইপিডেমিওলজি, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অফ বাংলাদেশ বলেন, বর্তমান সময়ে সড়ক দুর্ঘটনা একটি মারাত্বক স্বাস্থ্য ঝুঁকি যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মিলিতি প্রচেষ্টায় এবং সমন্বিত উদ্যেগের মাধ্যমে এটি সহনিয় মাত্রায় রাখা সম্ভব বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মোঃ সেলিম রেজা তার বক্তব্যে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের গৃহীত উদ্যোগ ও চলমান কার্যক্রমের কথা বলেন। তিনি আরও বলেন যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেল, মেকানিক্যাল সার্কেল ও সিভিল সার্কেল নামে তিনটি সার্কেল গঠন করে সড়ক নিরাপত্তা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।  তিনি আরও উল্লেখ করেন যে সড়ক দুর্ঘটনার ফলে বাংলাদেশ বিশেষ করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তিনি সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করার প্রধানমন্ত্রীর যে স্বপ্ন তাতে অবদান রাখতে ভবিষ্যতে সড়ক নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে রোডসাইড অবজারভেশনাল স্টাডি’র ফলাফল কাজে লাগানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন।

পরিশেষে তিনি বলেন, সড়ক নিরাপত্তা বর্তমান সময়ে একটি গভীর চিন্তার বিষয়। তবে এই সমস্যা সমাধানে সরকারী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সহ সংশ্লিষ্ট সকলে সম্মিলিতভাবে কাজ করছে যা অত্যন্ত ইতিবাচক।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে কাজী বোরহান উদ্দিন, ম্যানেজার, রোড সেইফটি, সিআইপিআরবি উপস্থিত সমলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিসের প্রচেষ্টার জন্য শুভেচ্ছা জানান এবং সাফল্য কামনা করেন।

অর্থসূচক/ এইচএআই

 

 

 

 

 

 

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.