প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষণের পরিবেশগত এবং আইনগত প্রেক্ষাপট

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) ও বারসিক’র যৌথ আয়োজনে আজ রবিবার (৪ জুন) সকালে “প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষণের পরিবেশগত এবং আইনগত প্রেক্ষাপট” বিষয়ক একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। উক্ত আয়োজনে সহ-আয়োজক হিসেবে ছিলো পরিবেশ উদ্যোগ, বাংলাদেশ ন্যাচার কনজারভেশন অ্যালায়েন্স (বিএনসিএ) ও সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি)।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ মনিরুজ্জামান’র সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রনালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ড. এস এম মনজুরুল হান্নান খান। গোলটেবিল বৈঠকের পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী এবং সকল অতিথিদের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষণ রোধের দাবিতে একটি মানববন্ধন করা হয়।

মূল প্রবন্ধে ড. এস এম মনজুরুল হান্নান খান বলেন, প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, দূষিত বায়ু জীববৈচিত্র্যের উপর বীরুপ প্রভাব ফেলছে। মাটি এবং জলাধারগুলোতে জমে থাকা বিষাক্ত প্লাস্টিক খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করছে এবং বিভিন্ন স্তরের জীবের খাদ্য চক্রে মিশে যাচ্ছে। তাই উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যকে যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। এর সাথে উন্মুক্ত পরিবেশে প্লাস্টিক পোড়ানো বন্ধ করতে হবে। প্লাস্টিকের ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রয়োগ এখন সময়ের দাবী।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রনালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার এমপি বলেন, প্লাস্টিক আমাদের দেশের সুন্দর পরিবেশকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিচ্ছে। প্লাস্টিক একাধারে মাটি, পানি ও সমুদ্র দূষিত করছে। প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বাতাসও দূষিত হচ্ছে, তাই এখন আর আমরা বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার জন্য নির্মল বাতাস পাই না। শুধু সরকার একা কাজ করে এই দূষণ কমাতে পারবেনা। ব্যক্তি পর্যায়ে প্লাস্টিক রিসাইকেল সম্ভব না হলেও আমরা চাইলে প্লাস্টিক রিফিউজ এবং রিইউজ করতে পারি। এতে করে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ অনেকাংশে কমে যাবে। দেশের নাগরিক হিসেবে সবাইকে সবার অবস্থান থেকে প্লাস্টিক দূষণ কমাতে সচেষ্ট হতে হবে এবং সরকারকে প্লাস্টিক দূষণের জন্য নির্ধারিত আইন প্রয়োগে সহযোগিতা করতে হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট খোদেজা নাসরিন আক্তার হোসেন, এমপি বলেন, প্লাস্টিক আমাদের নিত্যদিনের অতি প্রয়োজনীয় সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা চাইলেই খুব সহজে এর ব্যবহার বন্ধ করে দিতে পারবোনা। প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধের পূর্বে এর বিকল্প উদ্ভাবন করতে হবে এবং সবাইকে প্লাস্টিকের বিকল্প পণ্যকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবহার করতে হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, সকল মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় দরকার। প্লাস্টিক রোধে পরিবেশ বান্ধব বিকল্প প্রয়োজন। বাংলাদেশে পাটের ব্যাগ উদ্ভাবন হলেও সরকারের পক্ষ থেকে সদিচ্ছার অভাবে প্রচার প্রসার হয়নি। প্লাস্টিক দূষণ রোধে সামগ্রিকভাবে কাজ করতে হবে। আমাদের মন মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে পাঠ্যপুস্তক এর পাশাপাশি মানুষের ভাষায় কথা বলতে হবে।

বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষণের ভয়াবহতা উল্লেখ করে বলেন, মানব সভ্যতার উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার একই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্লাস্টিক দূষণও। ঢাকা শহরের মোট বর্জ্যের শতকরা ২০-৩০ ভাগই প্লাস্টিক। ফলে যেখানেই বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে সেখানে প্লাস্টিকও পোড়ানো হচ্ছে। এতে বায়ু দূষণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার প্লাস্টিকের পুড়ে যাওয়া অংশগুলো মাটি ও পানিতে মিশে মাটির উর্বরতা ও পানির গুণগতমান নষ্ট করে। ২০০২ সালে বাংলাদেশে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে নিয়ে আইন প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (২০০২ সনের ৯ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) অনুযায়ী ‘সব প্রকার প্লাস্টিক শপিং ব্যাগের উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ বিতরণ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ’। তাই আমাদেরকে প্লাস্টিক ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে বায়োডিগ্রেডেবল কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। বর্তমান বিশ্বে প্লাস্টিক উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহৃত হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে যেসব ক্ষতিকর গ্যাস এবং রাসায়নিক পদার্থ বাতাসে অবমুক্ত হয় প্লাস্টিক পোড়ানোর কারণেও একই রাসায়নিক পদার্থ অবমুক্ত হয়।

বিএনসিএ’র মহাসচিব মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক বলেন, প্লাস্টিক দূষণের কারণে বঙ্গোপসাগরের মাছ কমে গেছে। বিএফডিসি’র সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে মেরিন এ ৪৭৫ প্রজাতির মাছ সনাক্ত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন ফেসিয়ালিস ঘাটে ১৮ থেকে ২০ প্রজাতির বেশি মাছ দেখা যায় না ‌স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মাইক্রোপ্লাস্টিক থেকে বাঁচতে হলে বিদ্যমান পরিবেশন বাস্তবায়ন করা জরুরী।

সেন্টার ফর ল অ্যান্ড পলিসি এফেয়ার (সিএলপিএ) এর সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন বলেন, পুলিশকে তাৎক্ষণিকভাবে প্লাস্টিক ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে।

বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) এর সভাপতি সামিম আহমেদ বলেন, প্লাস্টিক নিয়ে আমাদের সচেতনতা কম। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় তারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনেক সচেতন। প্লাস্টিক এমন একটি পণ্য যেটি বারবার রিসাইক্লিং করা যায়। আমাদের উচিত আমাদের নিজেদের সম্পদকে ব্যবহার করে নিজেরা প্রতিষ্ঠিত হওয়া। প্লাস্টিককে বন্ধ করা সম্ভব নয় বরং আমাদের এই প্লাস্টিককে পুনরায় ব্যবহার করার প্রক্রিয়ায় যেতে হবে।

বারসিক এর সমন্বয়কারী মোঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আইনে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে একবার ব্যবহারযোগ্যে প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পলিথিন নিষিদ্ধের আইন অমান্যকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন প্রচলন করা জরুরী হয়ে পড়েছে।

ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস এর নির্বাহী সমন্বয়কারী সোহানুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে প্লাস্টিক পোড়ানোর কারণে বায়ু দূষণ একটি জরুরী পরিবেশগত এবং আইনি সংকট। আমরা তরুণেরা একটি পরিচ্ছন্ন এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ প্রাপ্য এটি শুধু জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত নয় বরং আমাদের সংবিধানও নিশ্চিত করা হয়েছে। এই অভ্যাস রোধে কঠোর নিয়ম, জরিমানা এবং সচেতনতামূলক প্রচারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উক্ত গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ এর উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ ইউনুস মিয়া সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি) এর প্রধান সমন্বয়কারী জনাব মোঃ শামসুদ্দোহা, রিভার ও ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ, নিরাপদ ডেভলপমেন্ট বাংলাদেশ নির্বাহী পরিচালক ইবনুল সাইদ রানা, পরিবেশ উদ্যোগ এর সমন্বয়ক ইঞ্জিনিয়ার মোঃ নাসির আহমেদ পাটোয়ারী, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর যুগ্ম সম্পাদক মিহির বিশ্বাস, সিজিইডি এর নির্বাহী পরিচালক আব্দুল ওহাব, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ এর অ্যাডভোকেসি ও ক্যাম্পেইন কোঅর্ডিনেটর মীর রেজাউল করিম, নোঙ্গরের সভাপতি সুমন সামস, বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এম শাফিউর রহমান এবং এইচআর শিপ ম্যানেজমেন্টের সিইও মো. মাহবুবুর রহমান প্রমুখ।

উক্ত গোলটেবিল বৈঠকে প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষণের পরিবেশগত প্রভাব মোকাবেলায় বেশ কিছু সুপারিশমালা তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলোঃ

 

১। পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পাট, কাপড়, কাগজের ব্যাগ ও ঠোঙ্গা (বায়োডিগ্রেডেবল) ব্যবহার করা, এগুলো সহজলভ্য করা এবং এসব ব্যাগ ও ঠোঙ্গা ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।

২। পলিথিন নিষিদ্ধকরণ আইন অমান্যকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন প্রচলন করা।

৩। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর পলিথিন এবং প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন, যেন বিদ্যালয় থেকেই শিশুরা সচেতন হতে পারে।

৪। পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগ তৈরির কাঁচামাল আমদানি বন্ধে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

৫। বন্ড লাইসেন্সের মাধ্যমে আমদানিকৃত পলি-প্রপাইলিন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

৬। উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্য যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে।

৭। উন্মুক্ত পরিবেশে প্লাস্টিক পোড়ানো বন্ধ করতে হবে এবং এই বিষয়ে আইন প্রনয়ন করতে হবে।

৮। পরিবেশ অধিদপ্তর, পাট অধিদপ্তর, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, এফবিসিসিআই, ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা।

 

অর্থসূচক/ এইচএআই

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.