মণিপুরে ফের সহিংসতায় জঙ্গি-পুলিশসহ নিহত ৪১

ভারতের বিজেপিশাসিত মণিপুরে নতুন করে সহিংসতায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে এক পুলিশ সদস্য ও কমপক্ষে ৪০ জন জঙ্গি নিহত হয়েছে। তবে নতুন করে মেইতেই এবং কুকি জনজাতির মধ্যে লড়াই হয়নি বলে দাবি করেছেন মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং।

মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযান চালিয়েছিল সেনা এবং আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানেরা। তাদের সঙ্গে কুকি জনজাতির বিচ্ছিন্নতাবাদীদের লড়াই হয়। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে একে ৪৭, একে ৫৬ এর মতো আধুনিক অস্ত্র ছিল বলে অভিযোগ। এই লড়াইয়েই অন্তত ৪০ জন কুকি সন্ত্রাসবাদীর মৃত্যু হয়েছে। বেশ কিছু সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছেন। তবে নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা বলেননি। তাদের কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার এখানে সেনা ও আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করেছে। এছাড়া আগামী ৩১ মে পর্যন্ত রাজ্যে অশান্ত এলাকায় ইন্টারনেটে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। অনেক জেলায় এখনও কারফিউ জারি রয়েছে।

জানা গেছে, মণিপুরে বিজেপি যাদের সঙ্গে কাজ করেছে এবং তারা ভোটের আগে যে অভিযোগগুলো এনেছিল, বিজেপি যেটা আনে যে সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হবে, বক্তব্যেও বলেছে এবং পরবর্তীতে তাদের সঙ্গেই সরকার গড়েছে। এসব চাপা দেওয়াসহ দেশ জুড়ে নিজেদের যে ব্যর্থতা তাকে চাপা দেওয়ার জন্য নর্থ-ইস্টে তারা নতুন করে এসব করছে। ভালো করে খবর নিয়ে দেখলে দেখা যাবে ‘মেইতেই’দের সংগঠিত করেছে ‘আরএসএস’ এবং কুকিকের মধ্যেও একাংশকে সংগঠিত করেছে ‘আরএসএস’। তারাই এই গোটা অঞ্চলে এসব করে বেড়াচ্ছে। এখানে তো কোনও মুসলিম নেই। এখানে খ্রিস্টানদের সঙ্গে হিন্দুদের ঝামেলা, এবং এরা দাঙ্গা বাধিয়ে দিচ্ছে।

এদিকে, মুখ্যমন্ত্রী গোষ্ঠী সংঘর্ষের কথা অস্বীকার করলেও শনিবার রাতে এবং রোববার রাজধানী ইম্ফল-সহ একাধিক এলাকায় গুলি চলেছে বলে জানা গেছে। রোববার ইম্ফলের কাছে দুই ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন বলে স্থানীয় সংবাদপত্রের খবর। ১২ জন আহত হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে সোমবারই ইম্ফল যাচ্ছেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। জনজাতিগুলির মধ্যে কীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়, সেই লক্ষেই তার যাত্রা বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সূত্রে জানানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এবং সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে শাহের বৈঠক হওয়ার কথা। তিনি তিনদিন মণিপুরে থাকবেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই মণিপুর উত্তাল। সংখ্যাগুরু মেইতেই গোষ্ঠীর সঙ্গে সেখানে বিরোধ শুরু হয় জনজাতি গোষ্ঠী কুকিদের। মেইতেইরা রাজ্যে জনজাতির সংরক্ষণ চায়। কুকিরা তার বিরোধিতা করছে। মেইতেইদের স্বপক্ষে সম্প্রতি মণিপুর হাইকোর্ট একটি রায় দেয়। এরপর মেইতেইরা একটি মিছিলের আয়োজন করেন। সেই মিছিল ঘিরেই প্রথম উত্তেজনা শুরু হয়।

সরকারি হিসেবে ওই সংঘর্ষে ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। অসরকারি সূত্রের দাবি, মৃতের সংখ্যা ৭১। অন্তত ৩৫ হাজার মানুষ পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতে আশ্রয় নিয়েছেন। গত সপ্তাহে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, শরণার্থীদের ফেরানোর ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। কিন্তু শনিবার রাত থেকে নতুন করে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সেই প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

ইম্ফল উপত্যকা অঞ্চলে ‘মেইতেই’ সম্প্রদায়ের প্রভাব রয়েছে। এরা বেশিরভাগই হিন্দু। মণিপুরের মোট জনসংখ্যায় তাদের অংশ প্রায় ৫৩ শতাংশ। মণিপুরের মোট ৬০ জন বিধায়কের মধ্যে ৪০ জন বিধায়ক ‘মেইতেই’ সম্প্রদায়ের। পাহাড়ি এলাকায় ৩৩টি স্বীকৃত উপজাতির বাস, যাদের মধ্যে প্রধানত ‘নাগা’ এবং ‘কুকি’ উপজাতির। এই দু’টি উপজাতিই প্রধানত খ্রিস্টান। মণিপুরের মোট ৬০ জন বিধায়কের মধ্যে ২০জন বিধায়ক উপজাতির। এছাড়া সেখানে প্রায় ৮ শতাংশ মুসলমান এবং প্রায় ৮ শতাংশ সানমাহি সম্প্রদায় রয়েছে।

‘মেইতেই’ সম্প্রদায়ের মানুষজন গত এক দশক ধরে উপজাতির মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। মেইতেইদের উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ার দাবির প্রতিবাদে ৩ মে ইম্ফলে এক বিরাট মিছিল বের করেছিল ‘কুকি’রা। সেই মিছিলকে কেন্দ্র করেই রক্তাক্ত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে উভয়পক্ষ। তারপর থেকেই উত্তাল হয়ে উঠেছে ওই রাজ্য। ২৫ দিনেরও বেশি সময় ধরে গোলযোগপূর্ণ এলাকায় বন্ধ রয়েছে ইন্টারনেট পরিসেবা। রয়েছে অন্যান্য বিধি নিষেধও। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে গত (শনিবার) উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যে আসেন সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ পান্ডে। কিন্তু গতকাল (রোববার) রাজ্যের পাঁচ জায়গায় হামলা চালায় অজ্ঞাত জঙ্গিরা। আর তারপরই জঙ্গিদমনে অভিযান শুরু করে সেনা-আধা সেনা ও পুলিশ সদস্য সমন্বিত যৌথবাহিনী। আট ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলা অভিযানে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয় কমপক্ষে ৪০ কুকি জঙ্গি। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর সফল অভিযানের খবর দেন মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং।

রাজ্যটিতে চলমান অশান্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রচুর পরিমাণে সেনা ও আধা সেনা জওয়ান মোতায়েন রয়েছে। জম্মু-কাশ্মীর বাদে বিগত বহু বছরে কোনও রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এত বিপুল সংখ্যায় সেনা মোতায়েন করতে হয়নি। একইসঙ্গে কাশ্মীর ছাড়া আর কোথাও অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে বিগত বহু বছরের মধ্যে ভারতের সেনা প্রধানের ঘটনাস্থলে যাওয়ারও নজির নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সূত্র: ডিডাব্লিউ, পার্সটুডে, পিটিআই, এএনআই

অর্থসূচক/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.