‘সরকারের উচিত অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি জনসাধারণের যত্ন নেওয়া’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি সুলতানা কামাল বলেছেন, সরকারের উচিত অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি জনসাধারণের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং বিকাশে আরো যত্নবান হওয়া।

বুধবার (১৭ মে) সকাল ১০ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন, এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ এর যৌথ উদ্যোগে উপকূলের ইলিশ ও জেলে বিষয়ক একটি জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সংলাপে সভাপতিত্ব করেন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র সভাপতি সুলতানা কামাল। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাপার সাধারণ সম্পাদক এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল।

সংলাপে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, বিশ্বে মাছ ধরায় বাংলাদেশের অবস্থান ৩য় এবং ইলিশ মাছ ধরায় ১ম। বাংলাদেশের ৫ লক্ষ্য জেলে সরাসরি ইলিশের সাথে সম্পৃক্ত। জিডিপিতে এই ইলিশের একক অবদান ১২% এবং বিশ্বের ৮০ ভাগ ইলিশের যোগান আসে বাংলাদেশ থেকে।

তিনি আরও বলেন, ইলিশের সংকট এবং জেলেদের জীবনযাত্রা উন্নয়নের জন্য সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে একসাথে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। ইলিশ ধরায় অবরোধের সময়কাল আঞ্চলিকভাবে একসাথে নির্ধারণ করতে হবে। জেলেদের ভরণপোষণের জন্য তহবিল গঠন করতে হবে এবং অবৈধ স্থাপনা বন্ধ করতে হবে।

সুলতানা কামাল বলেন, আজকে জেলেরা যেসব অভিযোগ জানিয়েছেন আমরা কেন তাদের সেই বিষয়ে কোনো ইতিবাচক তথ্য দিতে পারছিনা, এটা আমাদের ব্যর্থতা। একজন জেলের সংসার কি অনুদানের ৪০ কেজি চালে চলে কিনা সেটাও অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। তাদেরকে ভাতার যে কার্ড দেয়া হয় সেখানেও অনিয়ম এবং অপ্রতুলতার কারণে অধিকাংশ জেলেরাই এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকারের উচিত অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি জনসাধারণের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এবং বিকাশে আরো যত্নবান হওয়া।

খুলনা ৬ আসনের সংসদ সদস্য মোঃ আখতারুজ্জামান বাবু তার বক্তব্যে বলেন, মূলত পলির কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে এবং মাছ তার আবাসস্থল ও মাইগ্রেটরি রুট পরিবর্তন করে ফেলছে। বর্তমানে শহরে ও গ্রামে কোথাও পর্যাপ্ত বর্জ্য নিঃষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় এইসব ময়লা জলাশয় গুলোতে যেয়ে পানি দূষিত হয়ে মাছের স্বাদ ও গুণগত মান নষ্ট করে ফেলছে।

পটুয়াখালী ৩ আসনের সংসদ সদস্য এস এম শাহাজাদা তার বক্তব্যে বলেন, ইলিশ যে শুধু আমাদের রসনাবিলাসেরই অন্যতম নিয়ামক তা নয়, বর্তমানে ইলিশ আমাদের জাতীয় কূটনৈতিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে।

বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, এক সমীক্ষায় তথ্য এসেছে যে, ২০১০ সালে পশুর নদীর ১ লিটার পানিতে ৬০০০/৭০০০ মাছের ডিম পাওয়া যেত কিন্তু ২০১৭ সালের গবেষণায় দেখা গেছে তা লিটারে ২৬০০ তা নেমে এসেছে। সরকারী সমীক্ষায় ইলিশের উৎপাদন বাড়লে সাধারণ মানুষ কেন তা পাচ্ছেনা তা অনুসন্ধান করে বের করতে হবে।

মৎস্য গবেষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আলী আজহার বলেন, ইলিশ সংরক্ষণের পাশাপাশি ইলিশের সাথে সম্পৃক্ত জেলেদের জন্য বেতন এবং বিপদকালীন ইন্স্যুরেন্স এর ব্যবস্থা করতে হবে। জলদস্যু ও ডাকাতদের থেকে রক্ষায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের অধিকার রক্ষায় জাতীয় পর্যায়ে মৎস্যজীবী গ্রাম সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান গুলশান আরা লতিফা বলেন, সরকারের উচিৎ ইলিশের অভয়াশ্রমগুলোকে রক্ষায় উন্নয়ন প্রকল্পের পূর্ববর্তী গবেষণার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে এবং ইলিশ রক্ষায় প্রণীত সুরক্ষা আইনগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ ব্যবস্থাপনা শাখার উপপ্রধান মাসুদ আরা মমি বলেন, ২০০২-৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ভয়াবহভাবে হ্রাস পেলেও পরবর্তীতে সরকারের তাৎক্ষনিক পদক্ষেপে ২০০৩-৬ সালের মধে হিলশা ম্যানেজমেন্ট প্লান নেয়া হয়। সেই কার্যক্রমের সূত্র ধরে ২০১৮ সালে মৎস্য অধিদপ্তর মৎস্য সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে।

মহেশখালী, কক্সবাজার, পটুয়াখালী, বরগুনা, মোংলা ও পাইকগাছা থেকে আগত সংলাপে অংশগ্রহণকারী মৎস্যজীবী এবং মৎস্য ব্যবসায়ীগণ বলেন, বছরের বিভিন্ন সময়ে ইলিশ মাছ ধরার উপরে যে অবরোধ আরোপ করা হয় তা যেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অবরোধ সময়সীমার সাথে সামঞ্জস্য করে দেয়া হয়। এছাড়াও চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের মালবাহী জাহাজের কারণে তাদের মাছ ধরার জাল প্রতিনিয়ত কেটে যায়, জাহাজের বর্জ্য, পোড়া তেল জলাশয়ের পানিতে পতিত হয়ে এবং কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ দূষণ উৎপাদনকারী শিল্প কারখানার বর্জ্য মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করছে। মাঝসমুদ্রে ডাকাতি ও জলদস্যুদের আক্রমণ এবং মাছ না পাওয়ায় মহাজনের টাকা ফেরত না দিতে পেরে বহু জেলে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছে।

এছাড়া সংলাপে আয়োজক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও পরিবেশবিদ, সরকারী ও বেসরকারী, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিগণ এবং গনমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

অর্থসূচক/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.