লোকসানি কোম্পানির শেয়ারে এ কেমন উল্লম্ফন!

সিভিও পেট্রোকেমিক্যাল রিফাইনারী লিমিটেড। সাবেক নাম চিটাগং ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। লোকসানী এ কোম্পানি পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বেশি কারসাজির শিকার হওয়া কোম্পানিগুলোর অন্যতম। বিভিন্ন সময়ে এ কারসাজিতে খোদ উদ্যোক্তাদের সংশ্লিষ্টতারও অভিযোগ উঠেছে। বাজারে আবার নতুন করে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন নিয়ে কারসাজি শুরু হয়েছে বলে সন্দেহ করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। বুধবারের (১০ মে) লেনদেনচিত্র পর্যালোচনা করে এমন সন্দেহ করছেন তারা।

বুধবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সিভিও পেট্রোর শেয়ার লেনদেন ছিল নানা দিক থেকে অস্বাভাবিকতায় পূর্ণ। গত ছয় মাসে দিনে গড়ে ৪/৫শ শেয়ার বিক্রি হয়েছে যে কোম্পানির, বুধবার সে কোম্পানির ১৩ লাখ ৮৪  হাজার শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে; যা আগের দিনের ৫৪২ গুণ প্রায়। আগের দিন ডিএসইতে কোম্পানিটির মাত্র ২৫৫৪টি শেয়ার কেনাবেচা হয়েছিল।

বুধবার ডিএসইতে সিভিও পেট্রোর মোট বিক্রিত শেয়ারের মূল্য ছিল ২৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা। লেনদেনে শীর্ষ ২০ কোম্পানির মধ্যে সিভিওর অবস্থান ছিল তৃতীয় স্থানে।

স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় লেনদেনে এমন উল্লম্ফন সম্ভব নয় বলে মনে করেন বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, সার্কুলার ট্রেডিং, ক্রসিং ইত্যাদি অবৈধ নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই কেবল এটি সম্ভব। আর এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে- সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রলুব্ধ করে ফাঁদে ফেলা। সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরকে এই প্রতারণার হাত থেকে রক্ষায় আজকের লেনদেন ভালভাবে খতিয়ে দেখা উচিত।

যদিও বাজারের কোনো কোনো স্টেকহোল্ডার লেনদেনের এমন উল্লম্ফনকে অস্বাভাবিক ও কারসাজির অংশ হিসেবে মানতে রাজি নন। তাদের বক্তব্য, হঠাৎ বড় লেনদেন হলেই সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রলুব্ধ হবেন কেন? তাদেরকে তো কেউ শেয়ার কিনতে বাধ্য করছে না। তারা শেয়ার কিনছেন কেন। তারা লোকসানে পড়লে তার দায় অন্যদের দেওয়ার সুযোগ নেই।

তবে বাজার বিশ্লেষকরা এই ধরনের বক্তব্যকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন। তাদের ভাষ্য, বড় লেনদেন দেখে প্রলুব্ধ হয়ে শেয়ার কিনে লোকসানের শিকার হলে তার দায় অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিনিয়োকারীর নিজস্ব, বড় অংকের শেয়ার লেনদেনকারীর নয়। কিন্তু ওই বড় লেনদেন যদি হয় অবৈধ পন্থায়, বিধি লংঘন করে তাহলে সাধারণ বিনিয়োগকারীর লাভ-লোকসান বিবেচনায় নয়, আইন লংঘনের দায়েই ওই ধরণের লেনদেনের সাথে সংশ্লিষ্টদের কঠোর বিচারের মুখোমুখী করতে হবে।

বুধবার ডিএসইতে শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধিতে সিভিও পেট্রো ছিল সবার শীর্ষে। এদিন কোম্পানিটির শেয়ারের দাম মূল্য বৃদ্ধিতে সার্কিটব্রেকার স্পর্শ করেছে। স্টক এক্সচেঞ্জটিতে এই কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। দিনশেষে কোম্পানিটির শেয়ারের মূল্য দাঁড়ায় ১৭৯ টাকা ৫০ পয়সা, আগের দিন যার দাম ১৬৩ টাকা ৭০ পয়সা ছিল।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছরের ২৫ অক্টোবর থেকে গতকাল পর্যন্ত ডিএসইতে সিভিও পেট্রোর শেয়ার ১৬৩ টাকা ৭০ পয়সা দরে গড়াগড়ি খেয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে একদিনের জন্যেও কোম্পানিটির শেয়ার ফ্লোরপ্রাইসের উপরে উঠতে পারেনি। অথচ কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য বা ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধির খবর ছাড়াই আজ একদিনে কোম্পানিটির শেয়ারের মূল্য বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ; আর লেনদেন বেড়েছে প্রায় ৫৪২ গুণ।

সিভিও পেট্রোর ইতিবৃত্ত:

১৯৯০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটি প্রায় শুরু থেকেই ব্যবসায় নাকানিচুবানি খাচ্ছে। প্রথম দিকে কোম্পানিটি ভেজিটেবল অয়েল উৎপাদন করতো। কিন্তু টানা লোকসানের মুখে এটি ব্যবসা পুনর্গঠন করে। কিছু মেশিনারিজ পরিবর্তনের মাধ্যমে কনডেনসেট তথা প্রাকৃতিক গ্যাসের বর্জ্য থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদন শুরু করে। ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে বুদ্বুদের সময় এ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে বড় ধরনের কারসাজি হয়। অভিযোগ আছে, কোম্পানিটির পক্ষ থেকে তখন বাজারে এমন খবর রটানো হয় যে, তাদের উৎপাদিত থিনারের জন্য বড় বড় কোম্পানিকে সিরিয়াল দিয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এর পরেও থেমে থেমে কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে কারসাজি হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। তৎকালীন জোট সরকারের একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের ছত্রছায়ায় নানা অপকর্ম করেও পার পেয়ে গিয়েছে কোম্পানিটি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা নানা অনিয়ম দেখেও চোখ বন্ধ করে থেকেছে।

ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সাল থেকে টানা লোকসান দিয়ে চলেছে কোম্পানিটি। আর প্রতি বছরই বাড়ছে এই লোকসানের পরিমাণ। দেখা যায়, ২০২০ সালে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকসান ছিল ৫১ পয়সা। পরের বছর তা বেড়ে হয় ২ টাকা ৪৯ পয়সা। আর সর্বশেষ বছরে কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি ২ টাকা ৬৩ পয়সা লোকসান দিয়েছে। চলতি বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে শেয়ার প্রতি লোকসান দিয়েছে ৬০ পয়সা।

 

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.