চাপ বাড়ছে দেশের ব্যাংক খাতে

বাংলাদেশে ব্যাংকের নানা উদ্যোগেও কমানো যাচ্ছে না ডলার সংকট। বাধ্য হয়ে কমাতে হয়েছে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি। দেশের বাজারে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি থামছেই না। ডলার সংকটে বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠান বেশি দামে পণ্য আমদানি করছে। এতে সামনের দিনে এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ব্যাপকহারে কমতে পারে। এরফলে ব্যাংক খাতে ঋণ খেলাপি বহুগুণে বেড়ে যাবে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে দেশের ব্যাংক খাতে চিন্তা বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ধসে যাওয়া বড় তিন ব্যাংক।

সম্প্রতি বাংলাদেশের কয়েকটি ব্যাংক একক গ্রুপকে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়ে সংকটে পড়ে। এতে এসব ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট দেখা দেয়। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এসব ব্যাংকগুলোকে চাহিদামতো টাকার জোগান দেওয়া হয়েছে। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে সাপোর্ট না পেলে বিপদে পড়তে হতো ব্যাংকগুলোকে। তাই ইসলামী ধারার এসব ব্যাংকগুলো রক্ষা পেয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ধসে যাওয়া ব্যাংকগুলো স্টার্টআপ খাতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করতো। একইসঙ্গে বিটকয়েনসহ প্রচুর ডিজিটাল মুদ্রায় বিনিয়োগ করেছিলো। একইসঙ্গে আগ্রাসী ঋণ বিতরণ করা হতো। করোনা মহামারির পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বব্যাপি অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। এতে ক্রিপ্টোকারেন্সির দাম কমতে থাকে। এর ফলে খাতটি থেকে ব্যাংকগুলোর সম্পদ ব্যাপক কমে যায়। এছাড়া এই মন্দার মধ্যে স্টার্টআপ ব্যবসাগুলো সংকটে পড়ে। এতে ঋণ ফেরত পাওয়া অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়। এতে এসব প্রতিষ্ঠানের তহবিল সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এসব কারনেই ব্যাংকগুলোতে ধস পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক অর্থসূচককে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের যেসব ব্যাংকে ধস নেমেছে তাদের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। যেহেতু প্রেক্ষাপট ভিন্ন তাই তাদের সেই সমস্যা আমাদের এখানে আসার সম্ভাবনা নেই। পুঁজিবাজারের ব্যাংকগুলোর বিষয় বলেন, বিনিয়োগকারী ও আমানতকারী দুটি ভিন্ন বিষয়। বাজার ওঠা-নামা করবে এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং, আমানতকারীদের আমানত সুরক্ষিত থাকলে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আর যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলো যেসব কারনে ধসে পড়েছে তার প্রেক্ষিত ও প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তাই এসব বিষয় আমাদের দেশের ব্যাংক খাতের সঙ্গে না মিলানোই ভালো।

সারাবিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ নাজুক। এমন পরিস্থিতির প্রভাবে ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ডিজিটাল মুদ্রার ব্যাপক দরপতন হয়েছে। বাংলাদেশে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ ও লেনদেন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের ধসে যাওয়া ব্যাংকগুলো এসব খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেই বিপদে পড়েছে। তবে বাংলাদেশে সেই সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এদিকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি উঠেছিলো ৯ দশমিক ১০ শতাংশে। যা এর আগের ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিলো। এছাড়া ২০২০ সালের এপ্রিলে প্রথম ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে আমানতের সুদ ব্যাপকহারে কমে যায়। এতে উদ্যোগী হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দেয়, মেয়াদি আমানতের সুদ দেশের তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হতে পারবে না। তবে এখন ব্যাংকগুলোকে বেঁধে দেওয়া আমানতের সুদ হার মৌখিক ভাবে উঠিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণের সুদহার উঠিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশে। মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম সুদ পাওয়ায় ব্যাংকে আমানত রাখতে আগ্রহ হারাচ্ছে মানুষ। এতে ব্যাংকের আমানত আগের তুলনায় কমছে।

গত ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। বিতরণ করা এসব ঋণের মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। ফলে বিতরণ করা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশই খেলাপি। খেলাপির এমন চিত্র ব্যাংক খাতকে ব্যাপক ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের ব্যাংক খাতের করণীয় সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হাসান অর্থসূচককে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক ধসের ঘটনায় আমাদের দুটো বিষয় শিক্ষনীয় রয়েছে। প্রথমত প্রতিষ্ঠান যখন ভুল সিদ্ধান্তের কারণে দেউলিয়ার পথে চলে যায়, সেই প্রতিষ্ঠানকে কৃত্তিমভাবে টিকিয়ে রাখার কোনো যুক্তি নেই। এভাবে টিকিয়ে রাখলে সিষ্টেমের উপর মানুষের আস্থা কমে যায়। তখন মানুষ বলে এখানে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েও টিকে থাকা যায়। আর ভুল সিদ্ধান্তের মাশুল ব্যাংকের আমানতকারীকেই দিতে হবে। সুতরাং এখানে যদি কোনো সমাধানের দিকে নিয়ে যাওয়া না হয়, তাহলে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত দেউলিয়া হওয়ার জন্য দায়ী তাদেরকে খেসারত দিতে হবে। তাদের সহায় সম্পত্তি দিয়ে যতটা সম্ভব তাদেরই লোকসানের বোঝা বহন করতে হবে। কারণ একই প্রতিষ্ঠান কোটি টাকা লাভ করলে মালিকপক্ষই নিতো। ভুল সিদ্ধান্তে লোকসান হলে সেটাও তাদের নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ট্যাক্সের টাকা দিয়ে এসব দেউলিয়া ব্যাংক রক্ষা করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। তবে আমাদের দেশে প্রতিবছর বাজেটের টাকা দিয়ে বড় ধরনের সাপোর্ট দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে করদাতাদের সব বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। যেকোনো সিষ্টেমে প্রতিষ্ঠান ভালো থাকবে আবার খারাপও থাকবে, যা ন্যাচারাল। মানুষ ভরসার কোনো যায়গা না পেলেই কনফিডেন্স হারায়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি তার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করে তাহলে ক্রাইসিস আসলে মানুষের কনফিডেন্স আরও বেড়ে যায়। তবে আমানতকারীকেও সতর্ক হতে হবে। সম্পদ রাখার সময় ভালো-মন্দ বিবেচনা করে দেখতে হবে। দেউলিয়া পর্যায়ের ব্যাংকে টাকা রেখে হারিয়ে ফেলেলে সেই দায়ভার আমানতকারীরও।

এদিকে দেশের ব্যাংকগুলোতে গত বছরের এপ্রিল থেকেই ব্যাপক ডলার সংকট দেখা দেয়। অনেক ব্যাংক প্রয়োজনীয় আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারে নি। সংকট কাটাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ১ হাজার কোটি ডলারের বেশি বিক্রি করেছে। এতেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছিলো না। এসময়ের মধ্যে আমদানি কমাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার। এসবের প্রভাবে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল পরিশোধের পরিমাণ ১০ মাসে অর্ধেকের বেশি কমেছে। গত বছরের মার্চ-এপ্রিলে আকুর সর্বোচ্চ রেকর্ড পরিমাণ ২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারিতে আকু বিল দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক শূণ্য ৫ বিলিয়ন ডলার। এর ফলে রিজার্ভের ব্যাপক চাপ কিছুটা কমেছে।

অর্থসূচক/সুলাইমান/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.