সব দায়িত্ব কেন সরকারকেই নিতে হবে: বাণিজ্য সচিব

বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেছেন, সব দায়িত্ব কেন সরকারকেই নিতে হবে। যে সমাজে লাখ লাখ লোক আইন ভাঙ্গে, সে সমাজে আইন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। সবই সরকারের ওপর ছেড়ে দেবেন, আর নিজেরা যা ইচ্ছা তাই করবেন- সেটা তো গ্রহণযোগ্য হবে না।

বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। ‘বেসরকারি খাতের দৃষ্টিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (২০২২ সালের জুলাই-ডিসেম্বর) বাংলাদেশের অর্থনীতির সামগ্রিক পর্যালোচনা’ শীর্ষক এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।

সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ডিসিসিআই সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তার। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোহসিনা ইয়াসমিন। এছাড়া সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান এবং পিএইচপি ফ্যামিলির পরিচালক (ফিন্যান্স ও অ্যাডমিন) মোহাম্মদ আলী হোসেন অনুষ্ঠানে নির্ধারিত আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।

বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, সব দায়িত্ব কেন সরকারকেই নিতে হবে। ধরুন এনপিএল বাড়ায় সরকার কেন শাস্তি দেয় না, সেটা একটা ব্যাপার। কিন্তু ব্যাংকগুলো তো বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরাই চালায়। তারা কেন ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় না বুঝে-শুনে ঋণ দেয়। তাদের কি কোনো দায়িত্ব নেই! যেখানে লাখ লাখ লোক আইন ভাঙ্গে সে সমাজে আইন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। সেখানে দেখতে হবে, আমরা ব্যক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি কিনা না? আমরা উদ্যোক্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি কি না?  সবই সরকারের ওপর ছেড়ে দেবেন, আর নিজেরা যা ইচ্ছা তাই করবেন- সেটা তো গ্রহণযোগ্য না।

এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন বা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হওয়ায় ২০২৬ সালের পর রপ্তানি ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় ওই সময়ে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে ব্যবসায়ীদের এখন থেকে প্রস্তুতি নেওয়া দরকার বলে মনে করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ।

তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের এখন থেকে প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, নিজস্ব পায়ে দাঁড়িয়ে ব্যবসা করতে হবে। বিশ্বে অন্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে তাকে রপ্তানি করতে হবে। এই অর্থবছরে রপ্তানির ক্ষেত্রে ১৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা ক্যাস ইনসেনটিভ দেওয়ার জন্য নির্ধারিত আছে। ২০২৬ সালের পর এটা দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। তখন ডব্লিউটিও (ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন)- এর বিধিবিধান অনুযায়ী যে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায়, সেটা দেওয়া হবে।

তপন কান্তি ঘোষ বলেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমাদের অনেক জায়গায় হয় তো কিছু পরিবর্তন করতে হবে। সংস্কার করতে হবে, যেখানে অনেক হোমওয়ার্ক করতে হবে। আমেরিকা বাদে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আমরা বিনা শুল্কে রপ্তানি করতে পারি। এটা ২০২৬ সালের পরে অনেক দেশেই থাকবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশ এবং ইউকে (যুক্তরাজ্য) এখানে থাকবে ২০৩০ সাল পর্যন্ত। তারপরে আবার থাকবে না। এটা একটা বড় জায়গা।

আর একটা হচ্ছে ওষুধ রপ্তানিতে ট্রিপ (ট্রেড রিলেটড আসপেক্ট অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস চুক্তির আওতায়)- এর অধীন আমরা ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টরে যে সুবধিা পায়- পেটেন্ট ফি না দিয়েও অন্যের ফর্মুলা ইউজ করে আমরা ওষুধ তৈরি করতে পারি। এখন পেটেন্ট যদি আমাকে কিনতে হয়, ওষুধের দাম বেশি হবে। দাম বেশি হলে আমাদের দেশের ওষুধের দাম বেশি হবে। আমরা ১৪০টির মতো দেশে ওষুধ রপ্তানি করি, সেখানেও এর একটা প্রভাব পড়বে।

এছাড়াও তিনি বলেন, তার মানে এখন কম ভ্যালু অ্যাডিশন করে বেশিরভাগ শুল্ক সুবিধা পাচ্ছেন। তখন কিন্তু আপনার নিজের ব্যাকওয়ার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এবং অনেক ইনভেস্টমেন্ট লাগবে, যাতে আপনি অন্তত শতকরা ৫০ শতাংশ সেই সুবিধাটা পান। এমনকি আমাদের গার্মেন্টস খাতে এখন ৫০ শতাংশ ভ্যালু অ্যাডিশন নেই। আমরা শিল্পে অনেক ডাইভারসিফাই করেছি। অভ্যন্তরীণভাবে যদি আমরা দেখি বাংলাদেশে অনেক ধরনের শিল্প খুবই ভালো অবস্থানে গিয়েছে। কিন্তু এটাকে এক্সপোর্ট মার্কেটে আমরা এখনো নিতে পারিনি। এক্সপোর্ট সেক্টরের কাঁচামালের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হতো। এখন হয়তো সেক্টর কমে আসবে। এরকম অনেকগুলো যে সুবিধা আছে, সেই সুবিধা হয়তো আমরা আস্তে আস্তে দিতে পারবো না।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বর্তমান সময়ে দেশের রিক্সাচালকরাও সুদ হার নিয়ে কথা বলে। বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্কে ২০০৮ সালে দেশের ব্যাংক খাতের অবস্থান আরও শক্তিশালী ছিলো। এদিকে আমাদের রেমিট্যান্স কমে আসছে। বিদেশে দক্ষ জনবল পাঠাতে পারলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে।

এদিকে ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশ শক্তভাবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। তবে এ সময় টাকার মান কমেছে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। একইসঙ্গে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ বা ১ হাজার ৬৭৫ দশমিক ৯৬ মিলিয়ন ডলার। দেশের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ও এফডিআই বাড়ার পেছনে বেশ কিছু বাধা রয়েছে। এর মধ্যে অপর্যাপ্ত অবকাঠামো অন্যতম। একইসঙ্গে ব্যাপকহারে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির প্রভাবও পড়েছে। ওয়ান স্টপ সার্ভিসের অভাব ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সংস্কারের অভাব রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন ডিসিসিআই প্রেসিডেন্ট।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, যা সাউথ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) এনবিআরের আয় সংগ্রহ হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। যা এর আগের অর্থবছরের একইসময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। এছাড়া গত ডিসেম্বরে দেশে গড় মূল্যস্ফীতি ছিলো ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এরপরের মাস অর্থাৎ জানুয়ারিতে একটু কমে দাড়ায় ৮ দশমিক ৭৩ শতাংশে। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারিতে খাদ্য বহির্ভূত ও খাদ্য পণ্যে মূল্যস্ফীতি ছিলো যথাক্রমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ এবং ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ।

অর্থসূচক/এমএইচ/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.