বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা

দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাবেক জেলা ও দায়রা জজ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন।

সোমবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে নির্বাচন কমিশন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল এ ঘোষণা করেন।

সিইসি বলেন, রাষ্ট্রপতি পদে একজনই মনোনয়ন দাখিল করেছিলেন। দেশের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের জন্য জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী মনোনয়ন দাখিলের তারিখ ১২ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে দাখিলকৃত মনোনয়নপত্র পরীক্ষার পর মাত্র একজনের মনোনয়ন বৈধ থাকায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইন, ১৯৯১ এর ৭ ধারা অনুসারে মো. সাহাবুদ্দিনকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। এ বিষয় আজকেই প্রজ্ঞাপন জারির জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

এর আগে গতকাল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়। সকালে তার পক্ষে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে মনোনয়নপত্র জমা দেন দলের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা। এসময় তিনি নিজেও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য।

১৯৪৯ সালের ১০ ডিসেম্বর পাবনার জন্ম সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর। রাষ্ট্রপতি পদে জমা দেওয়া মনোনয়নপত্রের তথ্য অনুযায়ী, তার বাড়ি পাবনা সদর থানার শিবরামপুরে। ঢাকায় তিনি থাকেন গুলশানে। সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর বাবা শরফুদ্দিন আনছারী ও মা খায়রুন্নেসা। তিনি পাবনা শহরের পূর্বতন গান্ধী বালিকা বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর রাধানগর মজুমদার অ্যাকাডেমিতে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন।

১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করার পর পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে এইচএসসি ও ১৯৭১ সালে (অনুষ্ঠিত ১৯৭২ সালে) বিএসসি পাস করেন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং পাবনা শহীদ অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন আইন কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।

ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে তার পথচলা। দীর্ঘদিন পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ছাত্রলীগ নেতা হিসেবেই তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি পাবনা জেলা স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন। ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি পাবনা অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তিনি পরে যুবলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ১৯৭৪ সালে জেলা যুবলীগের সভাপতি হন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হলে তার প্রতিবাদ জানান তিনি। তখন গ্রেফতার হয়ে বেশ কয়েক বছর জেল খাটেন সাহাবুদ্দিন। এ সময় তিনি নির্যাতনেরও শিকার হন। জেল থেকে বের হয়ে তিনি পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। পাশাপাশি আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত হন। দুই বছর আইনজীবী হিসেবে যুক্ত থাকার পর ১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) ক্যাডারে তিনি মুন্সেফ (সহকারী জজ) পদে যোগ দেন।

কর্মের ধারাবাহিকতায় তিনি যুগ্ম জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা ও দায়রা জজ পদে দায়িত্ব পালন করে ২০০৬ সালে অবসরে যান। সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিযুক্ত সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিচারিক কাজের পাশাপাশি তিনি (১৯৯৬-২০০১) প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাসহ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের ডেস্ক অফিসার হিসেবে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন।

সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর ২০১১ সালের ১৪ মার্চ তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ২০১৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা, হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের ঘটনা তদন্তে পরবর্তী সময়ে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান (সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির পদমর্যাদায়) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন চুপ্পু। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার কারণ ও সুপারিশ প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিশনের দাখিলকৃত প্রতিবেদন সরকার গেজেট আকারে প্রকাশ করে।

দুদকের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিশ্বব্যাংক উত্থাপিত কথিত পদ্মা সেতু সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করেন এবং বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের মিথ্যা ও অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণে সমর্থ হন। তার তৈরি তদন্ত প্রতিবেদন কানাডার আদালতেও সমর্থিত হয়।

আওয়ামী লীগ সভাপতি তার গঠনতান্ত্রিক ক্ষমতাবলে ২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য হিসেবে চুপ্পুকে মনোনয়ন দেন। দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এইচটি ইমামের মৃত্যুতে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত শূন্য থাকা পদটিতে গত বছর (২০২২) ১৪ জানুয়ারি তাকে চেয়ারম্যান করা হয়। আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটিরও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন চুপ্পু।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মালিকানায় ব্যাপক পরিবর্তন এলে জেডএমসি বিল্ডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে ২০১৭ সালের জুন মাসে ব্যাংকটির পরিচালক হন চুপ্পু। পরে তিনি ব্যাংকটির ভাইস প্রেসিডেন্টেরও দায়িত্ব পালন করেন। সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ১৯৯৫ সালে পর পর দুইবার বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন। পেশাগত জীবনে প্রথম দিকে সাংবাদিকতাও করেছেন। তিনি পাবনা প্রেসক্লাব ও অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির জীবন-সদস্য।

অর্থসূচক/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.