আশায় শুরু হতাশায় শেষ

তৃতীয় দিনের শেষ বিকেলে শুরু হওয়া রোমাঞ্চ টিকে থাকলো পরদিন সকালেও। শিশির ভেজা সকালে বাংলাদেশের আশার আলো আরও খানিকটা জ্বালিয়ে দিলেন সাকিব আল হাসান আর মেহেদি হাসান মিরাজ।

৬.৩ ওভারেই নেই ভারতের পরের তিন ব্যাটার। ভয়ঙ্কর হওয়ার আগেই শেষ ঋষভ পান্ত। থিতু হওয়া অক্ষর প্যাটেলকে ফিরিয়ে ততক্ষণে ম্যাচের লাগাম টেনে ধরে বাংলাদেশ। তবে মুমিনুল হকের ক্যাচ মিসে বদলে যায় ম্যাচের দৃশ্যপট। জীবন পেয়ে বাংলাদেশকে ম্যাচ থেকেই ছিটকে দিলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। দারুণ ব্যাটিংয়ে সঙ্গ দিলেন শ্রেয়াস আইয়ার। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের রঙিন স্বপ্নকে বিষাদে রূপ দিয়ে ভারতকে ৩ উইকেটের জয় এনে দিলেন আইয়ার-অশ্বিনের ৭১ রানের জুটি। বাংলাদেশকে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ হারিয়ে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের আরও কাছে ভারত।

মিরপুরে জয়ের জন্য ১৪৫ রান তাড়ায় ভারতের হয়ে ব্যাটিংয়ে গিল আর লোকেশ রাহুল। সাকিবের দারুণ এক ডেলিভারিতে গিলের ব্যাট ফাঁকি দিয়ে বল আঘাত হানে তার প্যাডে। বাংলাদেশের অধিনায়কের জোরালো আবেদনে সাড়া দিলেন না আম্পায়ার। এমন সিদ্ধান্তে খুশি হতে না পেরে ততক্ষণাৎ রিভিউ নেন সাকিব। তবে রিপ্লেতে দেখা যায় বল লেগ স্টাম্প মিস করতো। একই ওভারের শেষ বলে আউট হতে পারতেন রাহুল। সাকিবের বলে ইনসাইড এজ হয়েছিলেন তিনি।

শর্ট লেগে ক্যাচ গেলেও সেটা লুফে নিতে পারেননি মুমিনুল হক। তাতে জীবন পান রাহুল। জীবন পেলেও ভারতের অধিনায়ককে সেটা কাজে লাগাতে দেননি সাকিব। নিজের দ্বিতীয় ওভারে বোলিংয়ে এসে ফেরান রাহুলকে। বাঁহাতি এই স্পিনারের বলে বেরিয়ে যাওয়া বল খেলতে গিয়ে উইকেটকিপার নুরুল হাসান সোহানের গ্লাভসে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন অভিজ্ঞ এই ব্যাটার। রাহুল ফেরার পর তাইজুল ইসলামকে সরিয়ে মেহেদি হাসান মিরাজকে বোলিংয়ে আনেন সাকিব।

বোলিংয়ে এসেই বাংলাদেশকে সাফল্য এনে দেন মিরাজ। ডানহাতি এই অফ স্পিনারের লেংথ ডেলিভারি চেতেশ্বর পূজারার ব্যাটে ইনসাইড এজ হয়ে বল উইকেটের পেছনে চলে যায়। সেসময় উইকেট থেকে বেরিয়ে গেছিলেন তিনি। ক্যাচ না হলেও স্টাম্পিং করেন সোহান। তাতে মাত্র ৬ রানে ফিরে যেতে হয় পূজারাকে। ডানহাতি এই ব্যাটার আউট হওয়ার পর অক্ষর প্যাটেল ও গিল মিলে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেন। তবে তাদের জুটিও বড় করতে দেননি মিরাজ।

ডানহাতি এই স্পিনারের অফ স্টাম্পের বাইরের লেংথ ডেলিভারিতে উইকেট থেকে বেরিয়ে ডিফেন্স করতে চেয়েছিলেন গিল। তবে ব্যাটে-বলে করতে পারেননি তিনি। সুযোগ মিস না করে গিলকে স্টাম্পিং করেন সোহান। তাতে ৭ রানে ফিরে যান গিল। অক্ষর একপ্রান্ত আগলে রাখলেও অন্য প্রান্তের ব্যাটাররা ছিলেন আসা-যাওয়ার মিছিলে। শেষ মুহূর্তে সেই মিছিলে যোগ দিলেন বিরাট কোহলি।

মিরাজের বলে ইনসাইড এজ হয়ে লেগ শর্টে মুমিনুলের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ২২ বলে ১ রান করা এই ব্যাটার। কোহলিকে আউট করার পর কিছু একটা বলে বসেন তাইজুল। তাতে চটে যান কোহলি। যা নিয়ে সাকিবের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। এরপর অবশ্য ভারতকে আর কোন উইকেট হারাতে দেননি অক্ষর ও জয়দেব উনাদকাট। দিন শেষে অক্ষর ২৬ এবং উনাদকাট অপরাজিত ৩ রানে। বাংলাদেশের হয়ে মিরাজ তিনটি উইকেট নিয়েছেন।

এর আগে দ্বিতীয় দিনের বিনা উইকেটে ৭ রান নিয়ে ব্যাটিংয়ে নামে বাংলাদেশ। ভারতকে টেক্কা দিতে দিনের প্রথম সেশনটা টিকে থাকার বিকল্প ছিল না দুই ওপেনারের। তবে নাজমুল হোসেন শান্ত ও জাকির হাসানের জুটি গড়েই উঠতে দিলেন না রবিচন্দ্রন অশ্বিন। ডানহাতি এই স্পিনারের লেংথ ডেলিভারিতে লেগ বিফোর উইকেট হয়ে সাজঘরে ফিরেছেন শান্ত। রিভিউ নিলেও শেষ পর্যন্ত রক্ষা হয়নি বাঁহাতি এই ওপেনার। প্রথম ইনিংসে ২৪ রান করা শান্ত এদিন আউট হয়েছেন মাত্র ৫ রানে।

শান্ত আউট হওয়ার পর জাকিরের সঙ্গে জুটি গড়া হয়নি মুমিনুল হকের। ফেরার ম্যাচে প্রথম ইনিংসের পুনরাবৃত্তি করতে পারলেন না বাঁহাতি এই ব্যাটার। মোহাম্মদ সিরাজের বলে চার মেরেই শেষ তার ইনিংস। ডানহাতি এই পেসারের অফ স্টাম্পের বাইরের বল খেলতে গিয়ে পান্তের গ্লাভসে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন ৫ রান করা মুমিনুল। তিনি আউট হওয়ার পর জাকিরকে নিয়ে জুটি গড়ার চেষ্টা করছিলেন সাকিব আল হাসান। শুরুতে খানিকটা আক্রমণাত্বক মনোভাব দেখালেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখেশুনে খেলার চেষ্টা করেছেন বাঁহাতি এই ব্যাটার।

জয়দেব উনাদকাটের খানিকটা লাফিয়ে উঠা বলে ক্যাচ উঠেছিল পয়েন্ট ও গালির মাঝে। তবে সেখানে ফিল্ডার না থাকায় বেঁচে যান সাকিব। তবে এক বল পরই আউট হতে হয়েছে বাংলাদেশের অধিনায়ককে। উনাদকাটের লেংথ ডেলিভারিতে শুভমান গিলকে রীতিমতো ক্যাচ অনুশীলন করিয়েছেন তিনি। এক্সট্রা কভারে দাঁড়িয়ে থাকা গিলের হাতে সহজ ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফিরেছেন ১৩ রান করা সাকিব।

প্রথম টেস্টের দুই ইনিংসেই ব্যর্থ হয়েছিলেন মুশফিকুর রহিম। ব্যর্থতা বজায় থাকলো ঢাকা টেস্টেও। প্রথম সেশন শেষ হওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে আউট হয়ে ফিরেছেন অভিজ্ঞ এই ব্যাটার। অক্ষর প্যাটেলের লেংথ ডেলিভারিতে ব্যাক ফুটে গিয়ে ডিফেন্ড করতে চেয়েছিলেন মুশফিক। তবে বল ব্যাটকে ফাঁকি দিয়ে আঘাত হানে প্যাডে। জোরালো আবেদনে সাড়া দিয়ে আউট দেন আম্পায়ার। রিভিউ নিলেও শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি। ৯ রানে ফিরেন মুশফিক আর রিভিউ হারায় বাংলাদেশ।

প্রথম সেশনে ভারতের দাপটের সামনে কেবল ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিয়েছেন জাকির। ৪ উইকেট হারানো বাংলাদেশ দিনের প্রথম সেশনে তোলেন মাত্র ৬৪ রান। লাঞ্চ থেকে ফেরার পর শুরুর দিকে খানিকটা অস্বস্তিতে ছিলেন জাকির। তবে দলের বিপদের মাঝেও হাফ সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন তিনি। উমেশ যাদবের স্ট্রেইট ড্রাইভ করে তিন রান নিয়ে ১২৯ বলে হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন জাকির। প্রথম টেস্টে হাফ সেঞ্চুরিকে তিন অঙ্কে রূপ দিলেও ঢাকায় ব্যর্থ হলেন তরুণ এই ব্যাটার।

উমেশের অফ স্টাম্পের বেশ খানিকটা বাইরের ডেলিভারিতে কাট করেছিলেন তিনি। জাকিরের উড়িয়ে মারা সরাসরি চলে যায় ডিপ থার্ডম্যানে থাকা সিরাজের হাতে। তাতে ৫১ রানে ফিরে যেতে হয় তাকে। জাকিরের বিদায়ের পর লিটনের সঙ্গে জুটি গড়তে পারেননি মেহেদি হাসান মিরাজ। অক্ষরের বলে অ্যাক্রোস দ্য লাইনে গিয়ে সুইপ করে লেগ বিফোর উইকেট হয়েছেন ডানহাতি এই ব্যাটার। ৫ বল খেললেও রানের খাতা খুলতে পারেননি তিনি।

দলীয় ১১৩ রানে মিরাজের বিদায় পর উইকেটে আসেন নুরুল হাসান সোহান। এদিন শুরু থেকেই আগ্রাসী মানসিকতায় খেলতে শুরু করেন এই উইকেটরক্ষক ব্যাটার। লিটন দাসকে দারুণভাবে সঙ্গ দিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু অক্ষর প্যাটেলের বলে স্টাম্পিং হয়ে বিদায় নিতে হয় তাকে। দ্রুত সময়ের মধ্যে লিটনের সঙ্গে ৪৬ রানের জুটি গড়েন তিনি। ফেরার আগে করেন ২৯ বলে দুটি চার ও একটি ছক্কায় ৩১ রান। এদিকে হাফ সেঞ্চুরি থেকে তখনও ২ রান দূরে লিটন। এমন সময়ে অক্ষরের বলে আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তে আউট হতে পারতেন ডানহাতি এই ব্যাটার।

অক্ষরের বল প্যাডে লাগতেই আউট দেন আম্পায়ার। তবে ততক্ষণাৎ রিভিউ নেন লিটন। রিপ্লেতে দেখা যায় বল স্ট্যাম্প মিস করতো। তাতেই রক্ষা পান। পরের ওভারে অশ্বিনের বলে স্লিপে ক্যাচ ছেড়েছেন বিরাট কোহলি। সেখান থেকে এক রান আসতেই ৭৪ বলে হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ হয় লিটনের। প্রথম সেশনে না পারলেও দ্বিতীয় সেশন নিজেদের করে নেয় বাংলাদেশ। এই সেশনে ৩ উইকেট হারানো বাংলাদেশ তোলে ১২৪ রান।

চা বিরতি থেকে ফেরার পর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি লিটন। সাত উইকেট হারানোর পরও তাসকিন আহমেদকে দারুণ এক জুটি গড়ে তোলেন তিনি। তাসকিনকে নিয়ে গড়েছেন ৬০ রানের জুটিও। তাসকিন ও লিটনের জুটি ভেঙেছেন সিরাজ। ডানহাতি এই পেসারের অফ স্টাম্পের বাইরে পড়ে ভেতরে ঢোকা বলে বোল্ড হয়েছেন লিটন। ডানহাতি এই ব্যাটার আউট হয়েছেন ৭৩ রানে। লিটন ফেরার পর তাসকিনকে সঙ্গ দিতে পারেননি তাইজুল ইসলাম।

আম্পায়ার্স কলের ফাঁদে পড়ে অশ্বিনের বলে লেগ বিফোর উইকেট হয়েছেন বাঁহাতি এই ব্যাটার। খালেদ আহেমেদও হেঁটেছেন তাইজুলের পথেই। অক্ষরের বলে মিড উইকেটে ঠেলে দিয়ে এক রান নিতে চেয়েছিলেন খালেদ। তবে গিলের দারুণ থ্রোতে রান আউট হয়ে ফিরতে হয়েছে তাকে। তাতে ২৩১ রানে অল আউট হয় বাংলাদেশ। ম্যাচ জিততে ভারতের লক্ষ্য ১৪৫ রান। ভারতের হয়ে অক্ষর তিনটি আর দুটি করে উইকেট নিয়েছেন অশ্বিন ও সিরাজ।

অর্থসূচক/এএইচআর

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.