পুঁজিবাজারের ব্যাংকগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগে ভাটা

বিভিন্ন সংকটে দেশের ব্যাংক খাত কঠিন সময় পার করছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে ব্যাপকহারে কমছে বিদেশি বিনিয়োগ। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৪টি ব্যাংকের মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ টানতে পেরেছে মাত্র ২৭টি ব্যাংক। এর মধ্যে ১৮ ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে।

বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে- এবি ব্যাংক লিমিটেড, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ব্র্যাক ব্যাংক, ইস্টার্ণ ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক।

বিনিয়োগ কমার বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ অর্থসূচককে বলেন, শুধু ব্যাংক খাত থেকেই বিদেশিরা টাকা তুলে নিচ্ছে না। মার্কেটের অন্য খাতের শেয়ারও তারা বিক্রি করছে। বিদেশিরা ভারত ও পাকিস্তানের বাজার থেকেও বিনিয়োগ তুলে নিয়েছে। তবে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার থেকে একটু বেশিই বিনিয়োগ তুলেছে। এসব বিনিয়োগকারীরা আবার কখন আমাদের মার্কেটে বিনিয়োগ করবে তা কেউ বলতে পারে না। আমাদের মার্কেটে শক্তিশালী ফান্ডামেন্টাল নেই। ব্যাংকিং খাতে মোটেও নেই। অন্যান্য দেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা আমাদের মতো এতটা খারাপ না। সেসব দেশের ব্যাংকের শেয়ারের দাম আরও অনেক বেশি। গত এক বছরে দেশের ব্যাংকগুলোর শেয়ারের দাম বাড়েনি বললেই চলে। খাতটিতে ক্যাপিটাল গেইনস একেবারে শূণ্য। দেশি-বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীদের ক্যাপিটাল গেইনস শূণ্য।

তিনি আরও বলেন, দেশের পুঁজিবাজারে আরও একটি সমস্যা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তৈরি করেছে। ছয় মাস আগে কমিশন ফ্লোর প্রাইজ আরোপ করেছে। বিদেশিরা যে কোনো মূল্যেই শেয়ার বিক্রি করতে চায়। তবে ফ্লোর প্রাইজের কারণে বিক্রি করতে পারছে না। এখন এসব বিনিয়োগকারীদের ব্লক মার্কেটে শেয়ার বিক্রি করতে দেখা গেছে। আমাদের এসব প্রাকটিসের সঙ্গে বিদেশিরা অভ্যাস্থ না। ফ্লোর প্রাইজ দেওয়ার সময় বিদেশিদের কথা একটুও চিন্তা করা হয়নি। এমন পদ্ধতি পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের পুঁজিবাজারে নেই। অপরদিকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখন যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য দেশে ডলারে বিনিয়োগ করতে চায়। কারণ ডলারের দাম ব্যাপকহারে বাড়ছে। বাংলদেশে ডলারের দাম বাড়লেও টাকার মান ধারাবাহিকভাবে কমছে। একই কারণে ভারতের পুঁজিবাজার থেকেও বিদেশিরা বিনিয়োগ তুলে নিয়েছে। তবে এখনো সেদেশের বাজারে বিদেশিদের অনেক বেশি সম্পৃক্ততা রয়েছে।

এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে তালিকাভুক্ত কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। এর প্রভাব দেশের পুঁজিবাজারে পড়ছে জানিয়ে আবু আহমেদ বলেন, ব্যাংকের ঋণ খেলাপি দুর্নীতি থেকেই তৈরি হচ্ছে। ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ কমানোর বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারলে তারা ক্রেডিট নিতে পারতো। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকও ক্রেডিট নিতে পারতো। আমাদের দেশে এমনভাবে ব্যাংকের টাকা বিতরণ করা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত আমানতকারীরা তাদের টাকা ফেরত পাচ্ছে না। অবশ্যই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উপর এসবের প্রভাব পড়ছে।

ডিএসইর তথ্য মতে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে এবি ব্যাংকের দশমিক ৮৮ শতাংশ শেয়ার বিদেশিদের দখলে ছিলো। তবে চলতি অর্থবছরের নভেম্বর শেষে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ কমে দাড়িয়েছে দশমিক ৭৯ শতাংশে। গত বছর শেষে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগ ছিলো দশমিক ৫২ শতাংশ, নভেম্বর শেষে পরিমাণ কমে দাড়ায় দশমিক ৪৮ শতাংশে। ব্র্যাক ব্যাংকের বিদেশি বিনিয়োগ গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় নভেম্বর শেষে ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ কমে দাড়িয়েছে ৩৪ দশমিক ০৪ শতাংশে। একই সময়ে ইস্টার্ণ ব্যাংকের বিদেশি বিনিয়োগ দশমিক ১৪ শতাংশ কমে ০.১৯ শতাংশে নেমেছে। এসময় বেসরকারি খাতের প্রিমায়র ব্যাংকেরও বিনিয়োগ কমেছে দশমিক ৮৭ শতাংশ।

অন্যান্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে এক্সিম ব্যাংকের বিদেশি বিনিয়োগ গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় নভেম্বরে কমেছে দশমিক ৩২ শতাংশ। বর্তমানে বেসরকারি খাতের এই ব্যাংকটির দশমিক ৯৭ শতাংশ শেয়ার বিদেশিদের দখলে রয়েছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে গত ডিসেম্বরে বিনিয়োগ ছিলো ১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। চলতি বছরের নভেম্বর শেষে ব্যাংকটিতে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে দাড়িয়েছে ১ দশমিক ২৫ শতাংশে। এছাড়া গত ডিসেম্বরে আইএফআইসি ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমিাণ ছিলো ১ দশমিক ০৭ শতাংশ। নভেম্বর শেষে তা কমে দাড়ায় ১ দশমিক ০৬ শতাংশে। একই সময়ে বেসরকারি খাতের যমুনা ব্যাংকেরও বিনিয়োগ কমেছে। ব্যাংকটির বিদেশি বিনিয়োগ দশমিক ০৮ শতাংশ কমে ০.৪৯ শতাংশে নেমেছে। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বিনিয়োগ সামান্য কমেছে। ব্যাংকটিতে গত ডিসেম্বরের তুলনায় বিদেশি বিনিয়োগ দশমিক ০৪ শতাংশ কমে ৪ দশমিক ০২ শতাংশে দাড়িয়েছে।

এছাড়াও বিদেশি বিনিয়োগ কমা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, স্টান্ডার্ড ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক এবং ইউসিবি।

অপরদিকে গত ডিসেম্বরের তুলনায় চলতি বছরের নভেম্বর শেষে তালিকাভুক্ত ৪ ব্যাংকের বিনিয়োগ সামান্য বেড়েছে। এসময় সিটি ব্যাংকের বিদেশি বিনিয়োগ ১ দশমিক ৬২ শতাংশ বেড়ে ৫ দশমিক ১৯ শতাংশে দাড়িয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে দশমিক ৪০ শতাংশ। একই সময়ে এনসিসি ব্যাংকের দশমিক ০৪ শতাংশ এবং সাউথইস্ট ব্যাংকের দশমিক ১৪ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে।

তবে আলোচ্য সময়ে তালিকাভুক্ত ৫ ব্যাংকের বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ অপরিবর্তিত রয়েছে। ব্যাংকগুলো হলো- ব্যাংক এশিয়া, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক এবং শাহাজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড।

এদিকে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৭ ব্যাংকে কোনো বিদেশি বিনিয়োগ নেই। এগুলো হলো- ঢাকা ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক, রুপালী ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংক।

অর্থসূচক/সুলাইমান/এমএস

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.