কয়েকদিনের মধ্যে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় হতে যাওয়া একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রথমটিতে যোগ দিতে বিশ্বনেতারা এখন ছুটছেন কম্বোডিয়ার নম পেনে।
তবে এসব আলোচনায় পরাশক্তিগুলোর মধ্যে বিভেদ ও সংঘাত ছায়া ফেলতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কাও করছেন।
সিএনএন জানিয়েছে, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের সম্মেলনে বিশ্বনেতারা তাদের প্রথম যাত্রাবিরতি নেবেন, দেখা করবেন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে।
এরপর ইন্দোনেশিয়ার বালি আর ব্যাংককে জি২০ ও এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কোঅপারেশন (এপিইসি) ফোরামের সম্মেলন।
২০২০ সালে কোভিড মহামারী শুরুর পর এবারই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ এ তিনটি সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা সশরীরে অংশ নিতে যাচ্ছেন।
কোভিড মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা, ইউক্রেইনে রাশিয়ার অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে বাড়তে থাকা খাদ্যের দাম ও বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানান ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সমন্বয় জোরদার করা সম্ভব কিনা, এই সম্মেলনগুলোতে অংশ নেওয়া বিপুল পরিমাণ কূটনীতিকের জন্য তার একটা পরীক্ষাও হয়ে যাবে।
গত কয়েকদশকের রাজনৈতিক দিনপঞ্জিতে বিশ্ব এখনকার মতো ভূরাজনৈতিক তীব্র ভেদাভেদ আর দেখেনি। ইউক্রেইনে যুদ্ধ রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমাদের সম্পর্কে নাটকীয় পরিবর্তন এনেছে। শীর্ষ দুই অর্থনীতির দেশের মধ্যে বাজার দখলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র হয়ে উঠেছে। এসবের মধ্যে বাকি বিশ্বের ওপর চাপ বাড়ছে- পক্ষ বেছে নেওয়ার।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এ সম্মেলনগুলোর কোনোটিতে অংশ নেবেন কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং চীনের শি জিনপিং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় হওয়া এ সম্মেলনগুলোর অন্তত দুটিতে অংশ নেবেন বলে জানা গেছে।
মহামারীর মধ্যে বছর দুয়েকের বেশি দেশের বাইরে বের না হওয়া শি এখন ফের বিভিন্ন দেশে সফরে যাচ্ছেন, এরমধ্যে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাও নিশ্চিত করে ফেলেছেন তিনি। এদিকে বাইডেনও প্রাচ্যে যাচ্ছেন ফুরফুরে মেজাজে, তার দল মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রত্যাশার চেয়েও ভালো করেছে।
দুই নেতাই সম্মেলনগুলোতে নিজ নিজ দেশকে শক্তিশালী অংশীদার এবং বিশ্বমঞ্চে অন্যের তুলনায় বেশি দায়িত্বশীল হিসেবে হাজির করতে চাইবেন।
জি২০ সম্মেলনের সাইডলাইনে তারা মুখোমুখি বৈঠকেও বসবেন বলে বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউস জানায়। বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর শি-র সঙ্গে এটাই তার প্রথম মুখোমুখি বৈঠক হতে যাচ্ছে।
শুক্রবার বেইজিংও শি যে জি২০ ও এপিইসি সম্মেলনে যাচ্ছেন তা নিশ্চিত করে। চীনের প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং একাধিক বিশ্ব নেতার সঙ্গে বৈঠক করবেন বলেও জানিয়েছে তারা।
শি-বাইডেন বৈঠক দুই পরাশক্তির মধ্যে উত্তেজনার আরও বৃদ্ধি রোধে ভূমিকা রাখলেও কয়েকদিনের মধ্যে হতে যাওয়া সম্মেলনগুলোতে বৈশ্বিক বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মধ্যে সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
এই সম্মেলনগুলোতে, এমনকী এর মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশি আঞ্চলিক আসিয়ান সম্মেলনেও বিশ্ব রাজনীতির বিভক্তির প্রতিফলনই দেখা যাবে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।
তবে অন্য দুই সম্মেলনে ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাব যতটা গুরুত্ব পাবে, আসিয়ানে হয়তো তেমনটা পাবে না; জোটের এক সদস্য রাষ্ট্রের ভেতরে ক্রমবর্ধমান সংঘাতই তাদের ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে।
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের দুই বছর পরও মিয়ানমারের টালমাটাল অবস্থা কাটেনি।
সেখানকার সংঘাত মোকাবেলায় ব্যবস্থা নিয়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যকার বিভক্তি, একেক পরাশক্তির সঙ্গে জোটের একেক সদস্যের আলাদা ধরনের সম্পর্ক এবং চীন, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে কোনো একটি পক্ষ বেছে নিতে জোটের অনাগ্রহ- এই সবকিছুই এবারের সম্মেলনে জোটটি কী অর্জন করতে পারবে এবং কোন কোন বিষয়ে কতখানি সম্মত হতে পারবে তার ওপর প্রভাব ফেলবে বলে ভাষ্য বিশ্লেষকদের।
“স্বভাবতই এবারের মৌসুম খুব রোমাঞ্চকর হবে। তিনটি বড় সম্মেলন দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায়, নম পেন, বালি আর ব্যাংককে।
“এর মধ্যে আসিয়ান রাশিয়ার আগ্রাসন, মিয়ানমারে অভ্যুত্থানজনিত সংকট, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের যুদ্ধংদেহী অবস্থান এবং আরও আরও বিষয় নিয়ে অনেকভাবে বিভক্ত। যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, আসিয়ানের খুব ভালো অবস্থায় নেই,” বলেছেন ব্যাংককের চুলালংকর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুষদের ইনস্টিটিউট অব সিকিউরিটি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের পরিচালক থিতিনান পংসুধিরাক।
গত মাসে জাতিসংঘে এক ভোটে ১০ সদস্যবিশিষ্ট আসিয়ানের ৭ সদস্যই ইউক্রেইনের চারটি অঞ্চলকে রাশিয়ার ভূখণ্ডভুক্তির নিন্দা জানিয়েছে; এই তালিকায় মিয়ানমারের প্রতিনিধিও আছে, যিনি সামরিক জান্তার অনুগত নন।
আসিয়ানের বাকি তিন দেশ থাইল্যান্ড, লাওস ও ভিয়েতনাম ভোটদানে বিরত ছিল।
এদিকে জোট হিসেবে আসিয়ান কিইভের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে পদক্ষেপও নিচ্ছে। বৃহস্পতিবার নম পেনে এক অনুষ্ঠানে ইউক্রেইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রি কুলেবার সঙ্গে তারা বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা বিষয়ক একটি চুক্তি করেছে।
কিন্তু আসিয়ান যদি তার ঘর ঠিক করতে না পারে, যদি সে মিয়ানমারের মতো দুষ্ট সদস্যকে বশে আনতে না পারে, তাহলে সে তার গুরুত্ব হারাবে। আর যদি সে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, অঙ্গীকার ও সংকল্পকে একজায়গায় আনতে পারে তাহলে সে অনেক কিছুই করতে পারবে,” বলেছেন পংসুধিরাক।
নম পেনের সম্মেলন মিয়ানমার সংকটের ওপর ফের আন্তর্জাতিক নজর ফেলতে পারে। গত বছরের এপ্রিলে আসিয়ান মিয়ানমারের জান্তার সঙ্গে একটি শান্তি পরিকল্পনায় উপনীত হতে পারলেও জান্তা সরকার সেটি কার্যকর না করায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশটি এখন সংকট মোকাবেলার অন্য কোনো পথ আছে কিনা, তা হাতড়াচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠন এবং অনেকেই মিয়ানমারকে আসিয়ান থেকে বের করে দিতে চাপ দিলেও নেপিডো এখনও আসিয়ানের অংশ, তবে জোটের বড় বড় আয়োজনে জান্তার প্রতিনিধিদের দেখা যাচ্ছে না।
গত মাসে আসিয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সংকট মোকাবেলার একটি কৌশল হাজির করার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, কম্বোডিয়া যতক্ষণ আসিয়ানের চেয়ারে আছে ততক্ষণ মিয়ানমার ইস্যুতে জোটটি কঠোর লাইন নেবে বলে মনে করছেন না তারা। এজন্যই সামনের বছরের দিকে তাকিয়ে আছেন তারা, তখন ইন্দোনেশিয়া আসিয়ানের নেতৃত্ব নেবে।
বাইডেনের সঙ্গে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর নেতাদের বৈঠকে মিয়ানমারের ‘চলমান সংকট’ প্রাধান্য পাবে বলে মঙ্গলবারই জানিয়েছিল হোয়াইট হাউস। দেশটিতে অভ্যুত্থানের পর থেকে বাইডেন প্রশাসন মিয়ানমারের সামরিক শাসনকে ‘টার্গেট’ করে একাধিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, জান্তাবিরোধী জাতীয় ঐক্যের সরকারের সঙ্গে বৈঠকও করেছে।
অন্যদিকে চীন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি তার সমর্থন প্রকাশ করেছে, যে কারণে তারা জান্তার বিরুদ্ধে কোনো বড় ধরনের পদক্ষেপে সমর্থন দেবে না বলেও মনে হচ্ছে।
মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে কয়েক মাসের তদন্ত শেষে আন্তর্জাতিক আইনজীবীদের একটি দল গত মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের জান্তাকে অস্ত্র সরবরাহ এবং তাদের শাসনকে বৈধতা দেওয়ার অভিযোগও এনেছে।
চলতি সম্মেলনেও চীন-রাশিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের জান্তার এ যোগসাজশের প্রভাব থাকবে বলে মনে করছেন সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক চং জা লান।
“জান্তার প্রতি চীন-রাশিয়ার সমর্থনের কারণে মিয়ানমারের সংকট সমাধানে আসিয়ানের যে কোনো উদ্যোগে দেশদুটিকে যুক্ত করা লাগবে; হয় তারা ওই উদ্যোগে সমর্থন দেবে, নাহলে অন্তত বিরোধিতা করবে না,” বলেছেন তিনি।
তবে আসিয়ানের এবারের সম্মেলনে কেবল যে মিয়ানমার সংকটই চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বিভক্তিকে সামনে নিয়ে আসবে তা নয়, এর সঙ্গে দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের আগ্রাসী ভূমিকা এবং ওয়াশিংটন-বেইজিং বাণিজ্য দ্বৈরথের প্রসঙ্গও থাকবে।
দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের ভূমিকা নিয়ে আসিয়ানের অনেক সদস্য দেশও ক্রুদ্ধ। সমুদ্রসীমা নিয়ে বেইজিংয়ের সঙ্গে তাদের বিরোধের কথাও অজানা নয়। তবে এবার ওই প্রসঙ্গ তেমন গুরুত্ব নাও পেতে পারে।
তবে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ওয়াশিংটন-বেইজিংয়ের মধ্যে চলমান বাণিজ্য বৈরিতার বিষয়টি যে তুলবে, তা অনেকটাই নিশ্চিত।
আসিয়ান তাদের সম্মেলনের পাশেই যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে আলাদাভাবে বসবে। তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে শি’র প্রতিনিধি হিসেবে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কুছিয়াং খানিকটা আগেই নম পেনে পৌঁছেও গেছেন।
“আসিয়ান দেশগুলো সবগুলো প্রসঙ্গ নিয়েই নাড়াচাড়া করবে; যুক্তরাষ্ট্র ও চীন তাদের জন্য কী কী সুযোগ রাখছে সেদিকটাও খতিয়ে দেখবে তারা,” বলেছেন চং।
অর্থসূচক/ এইচএআই