ডিজিটাল মুদ্রা নিয়ে ভাবছে না বাংলাদেশ ব্যাংক

ডিজিটাল মুদ্রার মাধ্যমে অনলাইনে আর্থিক লেনদেন করা যায়। বিদেশে ক্রয় করা পণ্যের দাম বিটকয়েনে পরিশোধ করা যাচ্ছে। পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ অর্থ এতে বিনিয়োগ হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত দ্রুত বাজারে ডিজিটাল মুদ্রা আনার ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজস্ব মুদ্রার ডিজিটাল সংস্করণ চালু করার লক্ষ্যে কাজ করছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এটি নিয়ে এখনো কিছু ভাবছে না বলে মত সংশ্লিষ্টদের।

এবিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আবুল কালাম আজাদ অর্থসূচককে বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে ডিজিটাল মুদ্রার অনুমোদন নেই। এবিষয়ে বিস্তারিত পরবর্তীতে জানানো হবে।

জানা গেছে, ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েনের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও লেনদেনের কোনো গ্যারান্টি নেই। এটি নিয়ন্ত্রণের জন্য নেই কোনো কর্তৃপক্ষ।
এসব মুদ্রায় ব্যাপক দরপতন হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এরপরও বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েনের চাহিদা এখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তবে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে দামে ব্যাপক পতন হয়েছে। ২০০৯ সালে মুদ্রাটির যাত্রার শুরুতে প্রতি বিটকয়েনের দাম ছিল এক ডলার। এরপরে বিটকয়েনের দাম সর্বোচ্চ ৬৪ হাজার ডলার ছাড়িয়েছিলো। জনপ্রিয় এই ডিজিটাল মুদ্রাটির ১০ অক্টোবর আবার দাম কমে ১৯ হাজার ৪০০ ডলারে লেনদেন হচ্ছে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশে বিটকয়েন লেনদেন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি দেশে এটি নিষিদ্ধ। তারপরেও বিশ্বে বিটকয়েনের লেনদেন ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আইন লঙ্ঘন করে ডিজিটাল মুদ্রাটির ব্যবসা বেআইনিভাবে বাংলাদেশেও বাড়ছে। একইসঙ্গে প্রতারণার ঘটনাও ঘটছে। বেআইনি এ মুদ্রা নিয়ে ব্যবসা করার দায়ে ইতিমধ্যে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে কয়েকটি মামলা হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা শাখার সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন অর্থসূচককে বলেন, ডিজিটাল মুদ্রা বা বিটকয়েনের ঝুঁকির দিকটি চিহ্নিত করতে হবে। এই মুদ্রা চালু করা বেশ ব্যয়বহুল একটি প্রক্রিয়া। ডিজিটাল মুদ্রা চালুর আগে যাচাই বাছাই করা জরুরী। পার্শবর্তী রাষ্ট্র ভারতে এটি চালু হলেও তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। তাই হুট করে এসব মুদ্রা চালু করলে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। খুবই সতর্কতার সঙ্গে ডিজিটাল মুদ্রার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে আইনি কাঠামো থেকে শুরু করে রেগুলেটরির বিষয়টি আগে থেকে পর্যালোচনা করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল মুদ্রা চালু করলে মানুুষ কেন কিনবে, কি কারণে কিনবে তা মানুষের সামনে প্রকাশ করা উচিৎ। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো এরকম কিছু বলেনি। ডিজিটাল মুদ্রায় ব্যাপক অনিয়ম হয়ে থাকে। এতে অনেক বেশি ঝুঁকি রয়েছে।

বাংলাদেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেনকে অবৈধ বলছে। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বিটকয়েন বা অন্য কোন ক্রিপ্টোকারেন্সি কেনাবেচা বা সংরক্ষণ করা বেআইনি।

ইন্টারনেট ব্যবহার করে দুইজন ব্যবহারকারীর মধ্যে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ না করেও বিটকয়েন সরাসরি আদান-প্রদান (পিয়ার-টু-পিয়ার) করা হয়। ২০১৩ সালের দিকে এই মুদ্রার দাম ১০ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার পর জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। এই লেনদেনের তথ্য ব্লকচেইন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকে। তবে এই মুদ্রার লেনদেন তদারকির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো কোন কর্তৃপক্ষ থাকে না।

বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে অন্যান্য দেশগুলো ভার্চুয়াল মুদ্রা নিয়ে পর্যালোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি কয়েকটি দেশ এটির অনুমোদনও দিয়েছে। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বিটকয়েনে লেনদেনের অনুমতি দেয় কেন্দ্রীয় আমেরিকার দেশ এল সালভাদর। দেশটির প্রেসিডেন্ট নায়েব বুকেলের নেতৃত্বে এমন উচ্চাভিলাষী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো দেশটি। লক্ষ্য ছিলো সালভাদরবাসীদের প্রতি বছর প্রবাসী আয়ের জন্য কমিশন ব্যয় ৪০ কোটি ডলার সাশ্রয় করা। যদিও পরবর্তীতে তা জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারে নি।

সম্প্রতি ডিজিটাল মুদ্রা চালুর বিষয়ে একটি খসড়াপত্র প্রকাশ করেছে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই)। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি বলছে, প্রাথমিকভাবে শুধু বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে এই মুদ্রা ব্যবহার করা যাবে। এর মধ্য দিয়ে আগামী দিনে ডিজিটাল লেনদেনব্যবস্থা আরও দক্ষ ও সুরক্ষিত করে গড়ে তোলাই মূল লক্ষ্য। একইসঙ্গে আর্থিক প্রতারণা ঠেকাতে চায় প্রতিষ্ঠানটি।

এর আগে ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ বলেছিলেন, ইন্টারনেটে ব্যবহার করা ক্রিপ্টো ডিজিটাল মুদ্র হিসেবে গণ্য হবে না। সেন্ট্রাল ব্যাংক ডিজিটাল কারেন্সিকে (সিবিডিসি) ডিজিটাল মুদ্রা করা হবে। শুক্রবার (৭ অক্টোবর) আরবিআই খসড়াপত্রে সেই ‘ই-রুপির’ ব্যাখ্যা দিয়েছে।

আরবিআই আরও বলছে, ডিজিটাল মুদ্রার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। বর্তমান অর্থব্যবস্থায় চালু থাকা সাধারণ মুদ্রার বিকল্প আনা মূল উদ্যেশ্য নয়। ডিজিটাল রুপিকে সাধারণ নোটের পরিপূরক করে তোলার চেষ্টা চলছে। এর ফলে আর্থিক লেনদেনে আরও একটি ডিজিটালব্যবস্থা চালু করা যাবে, যার সুবিধা সবাই ভোগ করতে পারবে। এই ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থার মাধ্যমে আরও বেশি মানুষকে প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক পরিষেবার আওতায় আনা এবং জালিয়াতি নিয়ন্ত্রণ করাও লক্ষ্য আরবিআইর।

বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল মুদ্রা চালু করার মূল উদ্দেশ্য হলো, ভার্চুয়াল লেনদেনের ক্ষেত্রে অর্থ আদান-প্রদান সহজ করা এবং স্টার্টআপ ও ই-কমার্স ব্যবসাকে উৎসাহ প্রদান।

বিশ্বে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ভার্চুয়াল মুদ্রা। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিটকয়েন, লাইটকয়েন, এথেরিয়াম, রিপলের মতো ভার্চুয়াল মুদ্রার লেনদেন হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশে এগুলো বৈধ নয়। ডিজিটাল এসব মুদ্রা লেনদেন হয় ভার্চুয়ালি অর্থাৎ টাকা বা কাগজের নোটের মতো এগুলো দৃশ্যমান নয়। তবে এখন যেসব ক্রিপ্টোকারেন্সি আছে সেগুলোর কার্যত কোন কর্তৃপক্ষ নেই এবং যে কান জায়গা থেকে যে কোন ব্যক্তি যে কোন সময় এর লেনদেন করতে পারেন।

এসব ভার্চুয়াল মুদ্রাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বিটকয়েন। ২০০৮ সালের শেষদিকে জাপানি নাগরিক সাতোশি নাকামোতো নামের একজন বা একদল সফটওয়্যার বিজ্ঞানী এই ‘ক্রিপ্টোকারেন্সির’ উদ্ভাবন করেন।

ক্রিপ্টোর প্রধান মুদ্রা বিটকয়েনের দাম প্রতিনিয়ত বেশ উঠা নামা করে। বিটকয়েনের মূল্য সর্বোচ্চ ৬৪ হাজার ডলার ছাড়িয়েছিলো। করোনার প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এরপরে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনীতির অবস্থা আরও খারাপ হয়। এসবের কারণে বর্তমানে বিটকয়েনের দাম ১৮ থেকে ২২ হাজার ডলারের মধ্যে ঘুরছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন খতিয়ে দেখছে যে ক্রিপ্টোকারেন্সিকে কীভাবে একটি মনিটরিংয়ের আওতায় আনা যায়। এসব মুদ্রার লেনদেন, বিনিময় হার এবং আইনগত ভিত্তি না থাকায় বড় বড় প্রতারণার ঘটনাও ঘটছে। এখন মুদ্রা আছে তিন ফরম্যাটে- কাগজের মুদ্রা, ই-মানি (মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস), ক্রিপ্টোকারেন্সি (বিটকয়েনের মতো ভার্চুয়াল মুদ্রা)। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নিজেদের মুদ্রা ডিজিটাল ফরম্যাটে আনলে সেটি হবে বৈধ ডিজিটাল মুদ্রা।

  
    

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়.